বিজ্ঞাপন
default-image

মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের বিভিন্ন এলাকার চিকিৎসকেরা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছেন। বিষয়টি পাকিস্তানপন্থীরা ভালোভাবে নেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এই চিকিৎসকদের অনেককেই তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে। নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করেছে। টাঙ্গাইলের এলএমএফ চিকিৎসক প্রবোধ চন্দ্র রায় ছিলেন তেমনই একজন শহীদ।

টাঙ্গাইল শহরের নিউমার্কেট রোডে টাউন ফার্মেসিতে ছিল প্রবোধ চন্দ্র রায়ের চেম্বার। এখানে বসেই তিনি রোগী দেখতেন। আবার শহরতলি বা গ্রামাঞ্চলে রোগীদের বাড়িতে গিয়েও চিকিৎসাসেবা দিতেন। মানুষের বিপদে-আপদেও তিনি পাশে দাঁড়াতেন। তাঁর চিকিৎসায় অনেকে বেঁচে উঠলেও তিনি নিজেকে রাজাকারদের কবল থেকে বাঁচাতে পারেননি।

টাঙ্গাইল শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রবেশ করে একাত্তরের ৩ এপ্রিল। আতঙ্কিত হয়ে অনেকেই গ্রামে পালিয়ে যান। প্রবোধ চন্দ্র রায়ও সপরিবার শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যান। কিছুদিন পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে এলে লোকজন শহরে ফিরতে থাকেন। প্রবোধ চন্দ্রের শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁকে বলেন, চিকিৎসকদের ক্ষতি করা হবে না, তিনি শহরে ফিরে যেতে পারেন। একপর্যায়ে প্রবোধ চন্দ্র শহরে ফিরে এসে চিকিৎসাসেবা শুরু করেন।

একাত্তরের ২২ অক্টোবর দুপুরের দিকে চেম্বারে রোগী দেখছিলেন প্রবোধ চন্দ্র। এ সময় বদর বাহিনীর সাত-আটজন ঢুকে পড়ে তাঁর চেম্বারে। ‘কথা আছে’ বলে নিয়ে যায়। তারপর তিনি আর ফিরে আসেননি। প্রবোধ চন্দ্রের বড় ছেলে কেশব চন্দ্র রায় জানান, তাঁর বাবাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর পরিবারের পক্ষ থেকে স্থানীয় মুসলিম লীগ ও শান্তি কমিটির নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তারা বলেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও খবরাখবর দেওয়ার জন্য তাঁর বাবাকে পাকিস্তানি সেনারা নিয়ে গেছে। এর কয়েক দিন পর তাঁরা জানতে পারেন, শহরের পানির ট্যাংকের পাশের বধ্যভূমিতে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। তবে তাঁরা লাশ পাননি।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৬ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমবেদনা জানিয়ে প্রবোধ চন্দ্র রায়ের স্ত্রী পার্বতী বালা রায়কে চিঠি ও দুই হাজার টাকার চেক পাঠিয়েছিলেন।

টাঙ্গাইল জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার খন্দকার আনোয়ার হোসেন বলেন, যুদ্ধ চলাকালেই প্রবোধ রায়কে হত্যা করার সংবাদটি তিনি পেয়েছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসহ নানাভাবে সহায়তা করছিলেন। হানাদার বাহিনীর এ দেশীয় দোসররা তাঁকে ধরে নিয়ে হত্যা করে।

প্রবোধ চন্দ্র রায়ের জন্ম ১৯২৬ সালের ১৫ জুলাই টাঙ্গাইল শহরের প্যারাডাইস পাড়ায়। তাঁর বাবা শশী মোহন রায় ছিলেন টাঙ্গাইল আদালতের আইনজীবী। মা শ্যামা তরঙ্গিনী রায় গৃহিণী। প্রবোধ চন্দ্র পঞ্চাশের দশকের শুরুতে টাঙ্গাইল শহরে চিকিৎসা পেশা শুরু করেন। তিনি স্ত্রী পার্বতী বালা রায় এবং চার ছেলে—কেশব চন্দ্র রায়, জগদীশ চন্দ্র রায়, কার্তিক চন্দ্র রায়, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং তিন মেয়ে—সুমী রানী রায়, দেবী রানী রায় ও গীতা রানী রায়কে রেখে যান।

বড় ছেলে কেশব চন্দ্র রায় জানান, মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিলেও তাঁর বাবার নাম শহীদ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়নি। তালিকাভুক্তির জন্য তাঁরা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন।

গ্রন্থনা: কামনাশীষ শেখর, টাঙ্গাইল