বিজ্ঞাপন
default-image

প্রবীণ আইনজীবী রায় সাহেব ললিত কুমার বল সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন না। তবে সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতেন। সে কারণে রাজাকারদের সহায়তায় মঠবাড়িয়া থানার তৎকালীন সিআই (সার্কেল ইন্সপেক্টর) পাকিস্তানপন্থী জালাল উদ্দিন তাঁকে ধরে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেয়। ঘাতক পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে লাশ খালে ফেলে দেয়।

শহীদ ললিত কুমার বলের জন্ম ১৮৯৮ সালের নভেম্বরে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার দক্ষিণ শিয়ালকাঠি গ্রামে। তাঁর বাবা ভারতচন্দ্র বল ছিলেন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। ললিত কুমার ১৯১৯ সালে বি এম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও ১৯২১ সালে স্নাতক পাস করে পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার কুড়িয়ানা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর আইনে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে পিরোজপুর বারে আইনজীবী হিসেবে যোগ দেন। আইনজীবী হিসেবে খ্যাতি অর্জনের পাশাপাশি পিরোজপুরে অনানারি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

আইন পেশা শুরুর পর ললিত কুমার রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৩০ সালে প্রথম ব্রিটিশ বঙ্গীয় পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত তিনি এমএলএ ছিলেন। ব্রিটিশ সরকার ললিত কুমার বলকে ‘রায় সাহেব’ উপাধি দেয়। ১৯৩৬ সালের নির্বাচনে হেরে গেলেও ১৯৪৬ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হননি, আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন। দেশভাগের পর ললিত কুমার বরিশাল বারে আইনজীবী হিসেবে যুক্ত হন। বরিশাল শহরের কাঠপট্টি মহল্লায় সপরিবার ভাড়া বাড়িতে বসবাস করতেন।

আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন ও সাহিদা বেগমের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আইনজীবী এবং আগামী প্রকাশনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থে ললিত কুমার বলের জীবনী ও হত্যার বিবরণ রয়েছে। দুটি বইতেই উল্লেখ আছে, ললিত কুমার বলের হত্যায় মুখ্য ভূমিকা ছিল মঠবাড়িয়া থানার সিআই জালাল উদ্দিনের। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ললিত কুমারের স্ত্রী বিন্দুবাসিনী বল ও মেয়ে তন্দ্রা বড়ালকে নিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন। কিন্তু সিআই জালাল উদ্দিন খবর পেয়ে তাঁকে আটক করে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। একাত্তরের ৭ জুন সকালে পাকিস্তানি সেনারা ললিত কুমার বল ও মঠবাড়িয়ার সার্কেল অফিসার (সিও) মাখন লাল দাসকে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের সামনে নিয়ে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। পাশের বহেরাতলা খালে ফেলে দেয় তাঁদের লাশ।

ললিত কুমার বলের স্ত্রী বিন্দুবাসিনী বল মারা গেছেন। তাঁর একমাত্র মেয়ে তন্দ্রা বড়াল বরিশাল বারের আইনজীবী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাবার মৃত্যুর পর তাঁরা ভারতে আশ্রয় নেন। দেশ স্বাধীন হলে ফিরে আসেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর মায়ের কাছে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি ও দুই হাজার টাকার অনুদান পাঠিয়েছিলেন। বরিশাল বার সমিতির সামনে শহীদ আইনজীবীদের স্মৃতিফলকে তাঁর বাবা শহীদ রায় সাহেব ললিত কুমার বলের নাম উৎকীর্ণ রয়েছে।


গ্রন্থনা: এ কে এম ফয়সাল, পিরোজপুর