গিয়াস উদ্দিন আহম্মদকে সপরিবার ধরে নিয়ে গিয়েছিল হানাদার পাকিস্তানি সেনারা। অন্যদের ছেড়ে দিলেও তাঁকে হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
শহীদ গিয়াস উদ্দিন আহম্মদের জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার গুণধর ইউনিয়নের জয়গা গ্রামে। তাঁদের বাড়ি এ অঞ্চলে ‘সাহেববাড়ি’ নামে খ্যাত। স্থানীয় বাসিন্দারা এই পরিবারের সদস্যদের এখনো ‘সাহেব’ বলে সম্মান জানায়। তাঁর বাবার নাম আফতাব উদ্দিন আহম্মদ।
গিয়াস উদ্দিন কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। তিনি আমৃত্যু গুণধর উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ও একই সঙ্গে টানা ১৬ বছর স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। জনদরদি গিয়াস উভয় কর্মক্ষেত্রের বেতন ও সম্মানীর সমুদয় অর্থ সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেছেন। পেশাগত কাজের পাশাপাশি সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা করতেন। কবিতা লিখতেন। বাড়িতে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার গড়ে তুলেছিলেন। এলাকায় অনেক মঞ্চনাটকে অভিনয়ও করেছেন। বাংলা একাডেমির শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ ও আগামী প্রকাশনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থে গিয়াস উদ্দিনের সংক্ষিপ্ত জীবনী রয়েছে।
হানাদাররা গণহত্যা শুরু করলে গিয়াস উদ্দিন স্থানীয় যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত করেন। তাঁর বাড়ি থেকে দুই শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার ও অন্যান্য আর্থিক ব্যবস্থা করতেন। সে জন্য তিনি স্থানীয় রাজাকার দলপতি হোসেন আলীর বিরাগভাজন হন। এই রাজাকার একাত্তরের ২৮ নভেম্বর হানাদার সেনাদের নিয়ে গিয়াস উদ্দিনের বাড়িতে হানা দিয়ে পরিবারের সবাইকে ধরে নিয়ে যায়।
সেই ঘটনার স্মৃতিচারণা করে গিয়াস উদ্দিনের দ্বিতীয় ছেলে ব্যবসায়ী রমিজ উদ্দিন আহম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, রাজাকার কমান্ডার হোসেন আলীসহ পাকিস্তানি সেনারা তাঁর বাবা, মা সুফিয়া আক্তার, বোন সামসুন্নাহার মাহমুদা, বড় ভাই শরফ উদ্দিন আহম্মদ, ছোট ভাই নিজাম উদ্দিন আহম্মদ ও তাঁকে আটক করে পার্শ্ববর্তী বালিয়াবাড়ি সেনাক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেনারা তাঁদের বাড়িতে লুটপাট চালায়। পাঠাগারসহ গ্রামের প্রায় ২০টি ঘরে আগুন দেয়। পরে গ্রামবাসী একত্র হয়ে সেনাদের জন্য কয়েকটি গরু, অনেক বস্তা চাল-ডাল নিয়ে তাঁদের ছাড়িয়ে আনতে যান। বাবাকে রেখে সন্ধ্যার দিকে পরিবারের অন্যদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এটাই ছিল বাবার সঙ্গে তাঁদের শেষ দেখা। পরে জেনেছেন, কালীগঞ্জ সেতুর নিচে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাঁর বাবাকেও হত্যা করে শীতলক্ষ্যা নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
রমিজ উদ্দিন বলেন, তাঁর বড় ভাই ব্যবসায়ী। ছোট ভাই প্রকৌশলী, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। বোনের বিয়ে হয়েছে। মা এ বছরের ৩০ মে ৮০ বছর বয়সে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বাবা শহীদ হলেও সরকারি স্বীকৃতি না পাওয়ায় তাঁদের আক্ষেপ রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা এখনো শহীদ গিয়াস উদ্দিনের মহত্ত্বের কথা মনে রেখেছেন। বাসিন্দারা জানান, গিয়াস উদ্দিন একজন ‘সাহেব’ হওয়া সত্ত্বেও খুবই সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। নিরহংকারী ছিলেন, ধনী-দরিদ্র সবার সঙ্গে ওঠবস করেছেন। এলাকার গরিব-দুঃখীদের নানাভাবে সাহায্য করতেন, মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন।
গ্রন্থনা: তাফসিলুল আজিজ, কিশোরগঞ্জ