বিজ্ঞাপন
default-image

ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার খামারগাঁও গ্রামের চিকিৎসক খগেন্দ্র জীবন মজুমদার মনেপ্রাণে ছিলেন স্বাধীনতার পক্ষে। মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা ও চিকিৎসা করতেন। তাঁর অপর দুই ভাই শিক্ষক হীরেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার ও ব্যবসায়ী ভূপেন্দ্র চন্দ্র মজুমদারও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী। এ কারণে পরিবারটির ওপর ক্ষিপ্ত ছিল স্থানীয় রাজাকার ও আলবদর বাহিনী। গৃহকর্মীদের সহযোগিতায় তারা মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে এই তিন ভাইকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। মুক্তিপণের জন্য দাবি করে মোটা অঙ্কের টাকা। টাকা দেওয়ার পরও তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়নি।

খগেন্দ্র জীবন মজুমদার ছিলেন এ অঞ্চলের খ্যাতিমান হোমিও চিকিৎসক। দূরদূরান্তের রোগীরাও তাঁর কাছে চিকিৎসাসেবা নিতে আসতেন। হীরেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার ছিলেন স্থানীয় বানাইল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ভূপেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার ব্যবসায়ী। খগেন্দ্র চন্দ্রের ভাইয়ের ছেলে শিক্ষক প্রবাল কান্তি মজুমদার জানান, এই সরকার বাড়িতে সারা বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ কর্মী (গোমস্তা) ছিলেন তারা মিয়া ও আবদুর রব। অনেক দিনের পুরোনো এই কর্মীদের প্রতি পরিবারের সবার অগাধ বিশ্বাস ছিল। কিন্তু তাঁদের লক্ষ্য ছিল তাঁর বাবা-কাকাদের হত্যা করে সম্পদ দখল করা।

পার্শ্ববর্তী বারুইগ্রাম মাদ্রাসায় ছিল রাজাকার ও আলবদরদের ঘাঁটি। এই ঘাঁটির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কিশোরগঞ্জ মহুকুমা শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পের। হানাদারদের মদদে রাজাকার–আলবদর সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা গ্রামে গ্রামে লুটপাট, স্বাধীনতাপন্থীদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা ও মানুষকে ধরে এনে মুক্তিপণ আদায় করার মাধ্যমে নান্দাইলে ত্রাস সৃষ্টি করে।

একাত্তরের ২৬ নভেম্বর বারুইগ্রাম ঘাঁটির আলবদরের সদস্যরা ওই সরকার বাড়িতে হানা দেয়। বাড়ির পুরোনো কর্মীরাই খগেন্দ্র জীবন মজুমদার, হীরেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার ও ভূপেন্দ্র চন্দ্র মজুমদারকে পিছমোড়া করে বেঁধে রাজাকার–আলবদরদের হাতে তুলে দেন। এরপর সবাই মিলে সরকার বাড়িতে লুটপাট করেন।

রাজাকাররা তিন ভাইকে তাদের বারুইগ্রাম মাদ্রাসার ঘাঁটিতে নিয়ে যায়। পরিবারকে জানায়, মোটা অঙ্কের টাকা দিলে ছেড়ে দেবে। পরিবারের লোকজন নানাভাবে ছয় হাজার টাকা জোগাড় করে রাজাকার ঘাঁটিতে পাঠান। কিন্তু টাকা নিয়েও শেষ পর্যন্ত তিন ভাইকে ছেড়ে দেয়নি। তাঁদের কিশোরগঞ্জে সেনাঘাঁটিতে পাঠায়। এরপর আর তাঁদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই তিন ভাইয়ের স্ত্রীদের কাছে সমবেদনা জানিয়ে আলাদা চিঠি পাঠান এবং সঙ্গে দুই হাজার টাকা করে অনুদান। পরিবারের সদস্যদের কাছে বঙ্গবন্ধুর সেই চিঠি সংরক্ষিত আছে। তবে তিন ভাইয়ের নাম শহীদদের তালিকায় ওঠেনি।

নান্দাইল মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ও সদ্য প্রয়াত গাজী আবদুস সালাম ভূঁইয়া বীর প্রতীক নিজ উদ্যোগে এই তিন ভাইসহ মুক্তিযুদ্ধে নান্দাইলের শহীদদের নাম–সংবলিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ নান্দাইল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পশ্চিম দিকের সড়কে স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু সড়ক সংস্কারের সময় সেই স্মৃতিস্তম্ভটি উপড়ে ফেলা হয়। পরে সেটি আর স্থাপন করা হয়নি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা।

স্বাধীনতার পর খগেন্দ্র চন্দ্র মজুমদারের স্ত্রী বিদ্যুৎপ্রভা মজুমদার বাদী হয়ে প্রায় ১৫ জন চিহ্নিত রাজাকারের বিরুদ্ধে হত্যা ও লুটপাটের অভিযোগে আদালতে মামলা করেন। ওই মামলায় গৃহকর্মী আবদুর রব ও তারা মিয়া এবং আবদুর রাশিদ, আবদুল কাদিরসহ কয়েকজন চিহ্নিত রাজাকারের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। সাজাভোগের পর এদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই।

গ্রন্থনা: রমেশ কুমার নান্দাইল, ময়মনসিংহ