বিজ্ঞাপন
default-image

‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুনে দারুণভাবে উদ্বেলিত হয়েছিলেন চিকিৎসক এম এ আজিজ সরকার। তিনি নিজ বাসভবনে বাংকার খুঁড়ে দুর্গ গড়ে তোলেন। তাঁর সহযোদ্ধা বলতে স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, বাড়ির কাজের লোক ও বাঙালি প্রতিবেশীরা।

সৈয়দপুর সেনানিবাসের প্রবেশমুখে বাঙালিপুর রেলওয়ে কলোনির ৯১১ নম্বর বাসভবনে বসবাস ছিল আজিজ সরকারের। চিকিৎসক হলেও তিনি চাকরি করতেন পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েতে হিসাবরক্ষক পদে। তবে সৈয়দপুর শহরে তাঁর ডিসপেন্সারি ছিল। অফিস সময়ের পর সেখানে বসে তিনি চিকিৎসাসেবা দিতেন। তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এলএমএফ কোর্সের শিক্ষা নেন।

আজিজ সরকার একাত্তরের ২৩ মার্চের আগে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত জাতীয় পতাকা তৈরি করে বিলি করেন মহল্লার বাঙালিদের মধ্যে। বাঙালিরা ২৩ মার্চ প্রজাতন্ত্র দিবসে পাকিস্তানের পতাকার স্থলে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন বাসাবাড়ির ছাদে ও দোকানে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয় বাঙালিবিদ্বেষী উর্দুভাষী বিডি মেম্বার বশির আলী এবং সন্ত্রাসী রুস্তম আলী, নঈম খান, জাহিদ ও আকবর। এরা ২৭ মার্চ তাঁকে বাধ্য করে অফিসে যেতে। তাঁর অফিস ছিল সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার কাছে। অফিসে পৌঁছে তিনি বাঙালি কর্মচারীদের পাকিস্তানের সঙ্গে অসহযোগিতার কথা বলেন। তিনি বাঙালি কর্মচারীদের নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়েও আসেন। পথে কারখানা গেটের সামনে বিহারিরা তাঁর গতিরোধ করে। তাঁর মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দেয়। সেখানেই তাঁকে রামদা ও ক্রিচ দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ঘাতকেরা তাঁর নিথর দেহ রেলওয়ে কারখানার ফার্নেসে (চুল্লি) নিক্ষেপ করে। তাঁর ছেলে দেলওয়ার হোসেন বাবার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

আজিজ সরকারের জন্ম ১৯২০ সালে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ভেন্ডাবাড়ি ইউনিয়নের বেহবতপুর গ্রামে। তাঁর বাবা আহমেদ আলী সরকার ছিলেন এ এলাকার নামকরা কবিরাজ। বাবার আগ্রহেই কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪১ সালে পাশের গ্রামের হাজি আবদুল জব্বার সরকারের মেয়ে হামিদা বেগমের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।

সৈয়দপুর শহরের উঁচু কলোনির সামনে সেনানিবাস সড়কে ‘জাহাঙ্গীর মেডিকেল হল’ নামে পরিপাটি ডিসপেন্সারি ছিল চিকিৎসক আজিজের। দরিদ্র রোগীদের তিনি বিনা মূল্যে চিকিৎসা দিতেন। আর এখানেই চলত এলাকার বাঙালিদের নিয়ে রাজনৈতিক আলাপ–আলোচনা। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলো নিয়ে অনেক কথা বলতেন তিনি সমবেত লোকজনের সঙ্গে। তিনি ছিলেন সাত ছেলে ও তিন মেয়ের বাবা। তাঁর চতুর্থ সন্তান দেলওয়ার হোসেন সুইডেনপ্রবাসী সাংবাদিক। সুইডেন থেকে তিনি মুঠোফোনে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা জানান। দেলওয়ার বলেন, তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শহীদ চিকিৎসক জিকরুল হকের সঙ্গে তাঁর বাবার গভীর সম্পর্ক ছিল।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সন্তান প্রজন্ম ৭১ সৈয়দপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মহসিনুল হক জানান, অকুতোভয় শহীদ চিকিৎসক এম এ আজিজের নাম সৈয়দপুর শহরে ‘স্মৃতি অম্লান’ নামের শহীদ স্মরণে নির্মিত সৌধে উৎকীর্ণ করা হয়েছে। এ ছাড়া রেলওয়ের স্মৃতিপার্কের স্তম্ভেও তাঁর নাম লেখা আছে। রেলওয়ের বিশেষ সংকলন ‘রেল বাতায়নে’ তাঁর নাম রয়েছে।

গ্রন্থনা: এম আর আলম, সৈয়দপুর, নীলফামারী