বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালের জুন মাসের ঘটনা। সেদিন সকালে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার মহিষকুণ্ডী গ্রামের শিক্ষক আবদুল কাদেরের বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ ও পাকিস্তানি হানাদার সেনার দল। এলাকার যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সংস্কৃতিমনা শিক্ষক আবদুল কাদেরকে তারা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। ঘটনাটি অনেকেই দেখেছিলেন। তবে ভয়ে কেউ কিছু করতে পারেননি। ঘাতকের দল তাদের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করে তাঁকে হত্যা করে। তবে পরিবার তাঁর লাশের খোঁজ পায়নি।

আবদুল কাদেরের জন্ম কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার মহিষকুণ্ডী গ্রামে। তাঁর বাবা খাদের আলী মণ্ডল ছিলেন গ্রামপ্রধান। ম্যাট্রিক পাস করে প্রথমে তিনি ভেড়ামারা পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি নেন। পরে ১৯৬৪ সালে মহিষকুণ্ডী হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কুষ্টিয়ার প্রাবন্ধিক ও গবেষক সেলিম রেজা শিক্ষক আবদুল কাদেরের ছবি ও তথ্য পাঠান। সেই সূত্রে অনুসন্ধান করা হয়।

শহীদ আবদুল কাদেরের বড় ছেলে জিয়া হায়দার প্রথম আলোকে জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁদের পরিবারের সদস্যরা পাশের গ্রাম রামকৃষ্ণপুরে নানা বাড়িতে ছিলেন। তাঁর বাবা একাই বাড়িতে থাকতেন। জুন মাসের শেষের দিকে একদিন সকালে তাঁরা জানতে পারেন, তাঁর বাবাকে পাকিস্তানি পুলিশ ও সেনারা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে। সেদিনই তাঁরা তিন ভাই বাড়িতে এসে খোঁজাখুঁজি করে বাবার সন্ধান পাননি। পরে তাঁরা সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যান। সেখানেই খবর পান তাঁর বাবাকে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা গুলি করে হত্যা করেছে।

আবদুল কাদেরকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তাঁর ছাত্র বর্তমানে মহিষকুণ্ডী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নাজিম উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা অনেকই বাড়ি থেকে শিক্ষক আবদুল কাদেরকে ধরে নিয়ে যেতে দেখেছেন। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তাঁকে রক্ষা করতে পারেননি। সংস্কৃতিমনা ও দেশপ্রেমিক আবদুল কাদের স্কুলে বাংলা ও ইংরেজি পড়াতেন। তিনি খুব ভালো অভিনয় করতেন। গ্রামে অনেক মঞ্চনাটক ও যাত্রাপালায় অভিনয় করেছেন। রাজশাহী বেতারে নাটকেও কণ্ঠ দিয়েছেন। আবদুল কাদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের নেতা ছিলেন।

মহিষকুণ্ডী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুস বলেন, এপ্রিল মাসের শেষ দিকে আবদুল কাদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য তাঁদের চার বন্ধুকে ২০০ টাকা দিয়ে সীমান্ত পার করে দেন। তিনি তরুণদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অনুপ্রাণিত করাসহ এলাকার শরণার্থীদের দেখভাল করতেন। প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে এসে তাঁরা জানতে পারেন, শিক্ষক আবদুল কাদেরকে হানাদার সেনারা নির্যাতন করে হত্যা করে।

মহিষকুণ্ডী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শহীদ আবদুল কাদেরের স্মরণে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৯৯০ সালে স্কুলে শহীদ আবদুল কাদের স্মৃতিমঞ্চ নির্মিত হয়েছে। এখানে ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত গ্রামবাসীর উদ্যোগে ‘শহীদ আবদুল কাদের স্মৃতি ফুটবল প্রতিযোগিতা’ আয়োজন করা হয়েছে। নানা কারণে পরে এই টুর্নামেন্ট বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৪ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক লে. কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ আলী জহীর বীর প্রতীক বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘দেশটাকে ভালোবেসে’ অনুষ্ঠানে শহীদ আবদুল কাদেরের কনিষ্ঠ সন্তান সেলিম রেজা অলোকের সাক্ষাৎকার প্রচার করেন। তাঁর সন্তানেরা চান শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে আবদুল কাদেরকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হোক।

গ্রন্থনা: তৌহিদী হাসান, কুষ্টিয়া