১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আহত বা অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিত্সাসেবা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সেক্টরে হাসপাতাল বা চিকিত্সাকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল। এ রকম একটি হাসপাতাল ছিল ২ নম্বর সেক্টরে। নাম ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’। এখানে ডা. জাফরউল্লাহ, ডা. মোবিন, ডা. আখতার, ডা. সিতারা বেগমসহ আরও অনেক চিকিৎসক, মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রী ও সেবিকা নিয়োজিত ছিলেন। এটি প্রথমে স্থাপিত হয় সীমান্তসংলগ্ন ভারতের সোনামুড়ায়। পরে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তা স্থানান্তর করা হয় আগরতলার কাছাকাছি বিশ্রামগঞ্জে। হাসপাতালটি গড়ে তোলা হয়েছিল ইট-সিমেন্টের তৈরি কোনো ভবনে নয়, দেয়াল বলতে চারদিকে বাঁশের বেড়া, মেঝে বলতে মাটির ভিত এবং বাঁশের চারটি খুঁটির ওপর মাচা বেঁধে পাতা হয়েছিল বিছানা। একেকটি ঘরে বিছানার সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০টি। কেবল অপারেশন রুমটি প্লাস্টিকের আবরণ দিয়ে ঘেরা। ওপর-নিচের চারদিকেই প্লাস্টিকের আবরণ। ভেন্টিলেশনের জন্য কয়েকটি জায়গায় ছোট ছোট ফোকর। বেশির ভাগ সময় দিনেই এখানে অপারেশন করা হতো। জরুরি কেস হলে রাতে হারিকেন বা টর্চলাইট জ্বালিয়ে অপারেশন করা হতো। শেষ দিকে অবশ্য জেনারেটরের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ডা. সিতারা বেগম জুলাইয়ের শেষ দিকে বাংলাদেশ হাসপাতালে যোগ দেন। পরে হাসপাতালের সিও (কমান্ডিং অফিসার) কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। তাঁকে এ পদে নিয়োগ দেওয়ার পর সামরিক হাসপাতাল যেভাবে চলে, সেভাবে এ হাসপাতালও পরিচালিত হতে থাকে।
ডা. সিতারা বেগম বাংলাদেশ হাসপাতালে অসাধ্য সাধনের মতো সব কাজ করতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিদিনই এ হাসপাতালে পাঠানো হতো। কেউ শেলের স্প্লিন্টারে আঘাতপ্রাপ্ত, কেউ গুলিবিদ্ধ। যতই আহত হন না কেন, মুক্তিযোদ্ধারা সেখানকার সেবায় চাঙা হয়ে উঠতেন। অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিত্সাও এখানে হতো। ওষুধপত্র ও চিকিত্সা-সরঞ্জামের স্বল্পতা সত্ত্বেও একজন ছাড়া আর কেউ এ হাসপাতালে মারা যাননি। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙা রাখতে তিনি ও তাঁর সহযোগীরা যে অবদান রেখেছেন, তা সত্যিই স্মরণীয়।
ডা. সিতারা বেগম কুমিল্লা সিএমএইচের চিকিৎসক ছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চে ছুটিতে তিনি বাড়িতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বড় ভাই এ টি এম হায়দারের সহায়তায় ভারতে চলে যান। পরে বাংলাদেশ হাসপাতালে যোগ দেন।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান