বিজ্ঞাপন
default-image

আকাশে ভটভট শব্দ। মুক্তিবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার আকাশে চক্কর দিতে দিতে খুব নিচে নেমে আসছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করে হেলিকপ্টার থেকে চালানো হচ্ছে আক্রমণ। নিচে থেকে হেলিকপ্টার লক্ষ্য করেও ছোড়া হচ্ছে গুলি। শোনা যাচ্ছে আর্তনাদ আর চিত্কারের ধ্বনি। চারদিকে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া। পাকিস্তানি সেনাদের ছোটাছুটি। তারা চেষ্টা করছে হেলিকপ্টারটি ধ্বংস করতে। তাতে আছেন সাহাবউদ্দিন আহমেদ, বদরুল আলম ও একজন গানার।

এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বরের। ঘটেছিল নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলায়। সেদিন খুব সকালে সেখানে হেলিকপ্টার থেকে ছত্রীসেনা নামায় মিত্রবাহিনী। কিন্তু আশপাশের গোপন আস্তানা থেকে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে ছত্রীসেনারা নিশ্চিত বিপর্যয়ের মুখে পড়েন। এ অবস্থায় মিত্রবাহিনী মুক্তিবাহিনীর নবগঠিত বিমানবাহিনীর সাহায্য কামনা করে।

খবর পাওয়া মাত্র মুক্তিবাহিনীর বিমানবাহিনীর একটি ইউনিট অস্ত্রসজ্জিত হেলিকপ্টার নিয়ে রায়পুরা অভিমুখে রওনা হয়। সাহাবউদ্দিন আহমেদদের পরিকল্পনা ছিল, তাঁরা দূর থেকে আক্রমণ চালিয়ে চলে যাবেন। কিন্তু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের ঝুঁকি নিয়ে বেশি নিচে নেমে আক্রমণ চালাতে হয়। বেশি নিচে নামার কারণে পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে তাঁদের হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে পাল্টা আক্রমণ চালানো সহজ হয়। কিন্তু সাহাবউদ্দিন আহমেদদের আক্রমণ এত জোরালো ও নিখুঁত ছিল যে সব বাধা উপেক্ষা করে তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর সফল অপারেশন চালান। তাঁদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২০ জন নিহত ও ২৪-২৫ জন আহত হয়। শত্রুপক্ষের বাকি সবাই সেখান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই অপারেশন শেষ করে তাঁরা হেলিকপ্টার নিয়ে নিরাপদে ফিরে যান।

সাহাবউদ্দিন আহমেদ ১০-১১টি অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি আরও দুটি অপারেশনে ওই ধরনের বিরূপ অবস্থার মুখে পড়েছিলেন। যেকোনো সময় তাঁর হেলিকপ্টার শত্রুর গুলিতে ধ্বংস হয়ে যেতে পারত। প্রায় একই রকমের অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন ৬ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারে এবং ৭ ডিসেম্বর সিলেটের শমশেরনগরে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিতে ওই দুই দিনের অপারেশনে তাঁর হেলিকপ্টার কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

সাহাবউদ্দিন আহমেদ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসে (পিআইএ) কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ৭ এপ্রিল ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নানা সাংগঠনিক কাজ করতে থাকেন। ২৮ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনীর বিমানবাহিনী গঠিত হলে তিনি তাতে যোগ দেন। প্রথমে তিনি জঙ্গি বিমান চালনার প্রশিক্ষণ নেন। পরে লোক-সংকটের কারণে তাঁকে হেলিকপ্টার চালনা বিভাগে স্থানান্তর করা হয়। হেলিকপ্টার চালনার মতো পূর্বাভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। তবে দিন কয়েকের প্রশিক্ষণে হেলিকপ্টার চালনায় তিনি দক্ষ হয়ে ওঠেন।

২০০৭ সালে বাংলাদেশ বিমানের চাকরি থেকে অবসর নেন তিনি।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান