বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালে শমসের মবিন চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। তখন তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রতিরোধযুদ্ধকালে চট্টগ্রামের কালুরঘাটের যুদ্ধে তিনি আহত হন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে বন্দী করে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার ঘটনা, কালুরঘাট যুদ্ধ ও বন্দী জীবনের ঘটনার কথা জানা যাক তাঁর নিজের বয়ানে (১৯৭৩)।

‘২৫ মার্চ রাত ১২টায় ষোলশহর ক্যান্টনমেন্টের গেটে গিয়ে গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। বৃষ্টির মতো গুলি।...এমন সময় কিছু বাঙালি সেনাকে গেটের কাছে দেখলাম। তাঁরা বললেন, “স্যার, বালুচ রেজিমেন্ট আমাদের ওপর হামলা করেছে এবং অনেককে মেরে ফেলেছে।” আমি সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে উঠে ষোলশহরে এইট বেঙ্গলে গেলাম।

‘সেখানে গিয়ে শুনলাম সকল পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২৬ মার্চ ভোরে আমরা কালুরঘাটের একটু দূরে পৌঁছলাম। কালুরঘাটে আমরা শপথ গ্রহণ করলাম। “বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমরা লড়াই চালিয়ে যাব।”

‘১১ এপ্রিল সকাল আটটার সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কালুরঘাটে ভীষণ আর্টিলারি ফায়ার শুরু করে। আমি ও মেজর হারুন (বীর উত্তম, তখন ক্যাপ্টেন, পরে মেজর জেনারেল) আমাদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করছিলাম। আমাদের সেনাসংখ্যা ছিল ৩৫। ওদের (পাকিস্তানি) ছিল ১০০-এর ওপরে।

‘মেজর হারুন ব্রিজের ওপর আহত হন। আহত হওয়ার পর তাঁকে অতি কষ্টে পুলের অপর দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে (মুক্তিযোদ্ধাদের) পিছু হটতে নির্দেশ দিলাম। আমাকে একজন সেনা (মুক্তিযোদ্ধা) চলে যেতে বলল। আমি বললাম, তোমরা যাও, আমি আসছি।

‘আমি রয়ে গেলাম। হঠাত্ আমি নিজেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক ঘেরাও অবস্থায় দেখলাম। অন্য সবাই পুলের অপর পারে চলে যেতে সক্ষম হয়। আমি ট্রেঞ্চ থেকে বের হয়ে চারদিকে চায়নিজ স্টেনগান দিয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করলাম। চোখের সামনে তিনজন পাকিস্তানি সেনাকে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখলাম। তারপর একটা গুলি এসে আমার কোমরে লাগে। আমি গুরুতরভাবে আহত হয়ে পুলের ওপর পড়ে গেলাম।

‘আমি ভাবতে থাকলাম শত্রুরা আমাকে ধরে ফেলবে। আমি ওদের হাতে ধরা পড়ার চেয়ে আত্মহত্যা করে মৃত্যুকে শ্রেয় বলে স্থির করলাম। কিন্তু স্টেনগানটা দূরে ছিল। তাই এটা সম্ভব হলো না। শত্রুরা আমাকে ধরে নিয়ে যায় এবং বন্দী করে রাখে।

‘তারপর আমাকে ঢাকা পাঠিয়ে দেয়। বন্দী শিবিরে রাখা হয় এবং (আমার ওপর) অশেষ নির্যাতন চালানো হয়। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। আমি মুক্ত হয়ে যাই।’

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান