বিজ্ঞাপন
default-image

সহযোদ্ধা নৌ-কমান্ডোদের সঙ্গে শফিকুন নূর মাওলা (এস এম মওলা) সাঁতার কেটে যেতে থাকলেন সমুদ্রের গভীরে। পানির মধ্যে তাঁদের পায়ের ফিনস অনবরত ওঠানামা করছে। এক ঘণ্টার বেশি সময় সাঁতরে তাঁরা মাথা তুলে তাকালেন লক্ষ্যস্থলের দিকে। দেখলেন লক্ষ্যস্থল তখনো অনেক দূরে। আরও আধা ঘণ্টা সবাই সমানতালে সাঁতার কাটলেন। তার পরও দূরত্ব কমল না। ক্লান্ত হয়ে গেলেন তাঁরা। সামনে কিংবা পেছনে যাওয়ার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন। চরম দুঃসাহস প্রদর্শন করেও ব্যর্থ হলেন তাঁরা। এ ঘটনা চট্টগ্রাম নৌবন্দরের বহির্নোঙরে ঘটেছিল ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকের কোনো একদিন।

দুঃসাহসী এই অপারেশনের জন্য নৌ-কমান্ডোরা রেকি করেছিলেন। কিন্তু রেকিতে তাঁদের একটা বড় ভুল হয়। সেটা হলো দূরত্বের হিসাব। তাঁরা অনুমান করেছিলেন বহির্নোঙরের দূরত্ব দেড়-দুই মাইলের বেশি হবে না। কিন্তু বাস্তবে এই দূরত্ব ছিল তিন-চারগুণেরও বেশি। জলপথের দূরত্ব হিসাব করার ব্যাপারে তাঁরা অভিজ্ঞ ছিলেন না। নৌ-কমান্ডোরা তাঁদের অজ্ঞাতেই বিরাট এই ভুল করে ফেলেন। রহস্যের এই নিষ্ঠুর মরীচিকা তাঁদের জন্য দুঃখময় এক মরণফাঁদ রচনা করে।

এস এম মাওলাসহ দুঃসাহসী নয়জন নৌ-কমান্ডো রাতে ভাটার সময় সমুদ্রের পানিতে নেমে লক্ষ্যস্থলের দিকে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু দেড় ঘণ্টার বেশি সময় সাঁতরেও তাঁরা সেখানে পৌঁছাতে পারেননি। দেড় ঘণ্টা ধরে একটানা সাঁতরানোর পর এতই ক্লান্ত হয়ে পড়েন যে তাঁরা সামনে বা পেছনে ফেরার শক্তিও হারিয়ে ফেলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁদের অভিযান শেষ হয় ট্র্যাজিক ঘটনার মধ্য দিয়ে।

পরে জোয়ারের প্রবল ধাক্কায় পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় সমুদ্রের তীরে পৌঁছান। তখন তাঁদের অনেকের জ্ঞান ছিল না। নয়জনের মধ্যে শফিকুন নূর মাওলাসহ চারজন মৃতপ্রায় অবস্থায় যেখানে ভেসে ওঠেন, সেখানে ছিল সশস্ত্র প্রহরা। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের দেখে ফেলে। সেনারা তাঁদের আটক করে। তাঁদের ব্যাপক নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। নির্যাতনে একজন (মোহাম্মদ হোসেন, বীর প্রতীক) মারা যান। শফিকুন নূর মাওলাসহ তিনজনকে পরে ঢাকা সেনানিবাসে পাঠানো হয়। এখানেও চলে তাঁদের ওপর প্রচণ্ড নির্যাতন। স্বাধীনতার পর তাঁরা ছাড়া পান।

শফিকুন নূর মাওলা ১৯৭১ সালে ঢাকার তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে চলে যান। ভারতে তিনি মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডো দলে যোগ দেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান