বিজ্ঞাপন
default-image

শওকত আলী প্রতিরোধযুদ্ধে যোগ দিতে যাচ্ছেন। তাঁর বাবা পথ আটকে বললেন, ‘তুই যাসনে। এ ঘটনা তিন দিনেই থেমে যাবে। আগেও এ রকম ঘটনা অনেক ঘটেছে। শেষ পর্যন্ত কিছুই হবে না।’ কিন্তু তাঁর মা বললেন, ‘ওকে যেতে দাও। দেশের দুর্দিনে সে ঘরে বসে থাকতে পারে না।’ এরপর বাবা তাঁকে আর আটকালেন না।

শওকত আলী ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মার্চের মাঝামাঝি যান তাঁর বাবার কর্মস্থল চট্টগ্রামে। বাবা ছিলেন রেলওয়ের চিফ ট্রাফিক ম্যানেজার। ১১ এপ্রিল কালুরঘাটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরাট একটি দল প্রতিরোধযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। এ সময় সেতুর পশ্চিম প্রান্তে বাঁ দিকে তিনি ও কয়েকজন গণযোদ্ধা প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিলেন। ডান দিকে ক্যাপ্টেন হারুন আহমদ চৌধুরী (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল) ও কয়েকজন গণযোদ্ধা। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের ঘেরাও করে ফেলে। এ সময় হারুন আহমদ চৌধুরীর পেটে গুলি লাগে। তিনি সেতুর ওপর পড়ে যান। প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে তাঁকে উদ্ধারের কাজটি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজই করেন শওকত আলী। সেদিনের যুদ্ধে তাঁদের আটজন শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধা শমসের মবিন চৌধুরী আহত অবস্থায় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বন্দী হন। এভাবে কালুরঘাট যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

এরপর ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে তাঁরা অবস্থান নেন রাঙামাটি জেলার নান্নেরহাট থানার বুড়িরহাটে। ১৮ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডো ব্যাটালিয়ন তাঁদের অবস্থানে আক্রমণ করে। তখন তাঁদের লোকবল খুবই কম। গোলাবারুদ নেই বললেই চলে। শুধু অসীম মনোবল ও প্রত্যয় নিয়ে তাঁরা দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ করেন এবং একসময় পিছিয়ে যান। মুন্সী আবদুর রউফ (বীরশ্রেষ্ঠ) এখানে শহীদ হন। এরপর তাঁরা অবস্থান নেন মহালছড়িতে। ২৭ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডো দল স্থানীয় মিজোদের সঙ্গে নিয়ে তিন দিক থেকে তাঁদের আক্রমণ করে। এ সময় তিনি ছিলেন ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের (বীর উত্তম) সঙ্গে। প্রচণ্ড যুদ্ধের একপর্যায়ে তাঁর চোখের সামনেই গুলিবিদ্ধ হন আফতাবুল কাদের। শওকত আলী সহযোদ্ধা ফারুককে সঙ্গে নিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে রামগড়ে যান।

শওকত আলী এরপর ভারতে যান। পরে যোগ দেন প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সে। প্রশিক্ষণ শেষে ১ নম্বর সেক্টরের মনুঘাট সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে যোগ দেন। ফটিকছড়িতে এক যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এক অফিসারসহ বিপুলসংখ্যক সেনা তাঁদের হাতে নিহত হয়। পরে হেঁয়াকো-নাজিরহাটে তাঁরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে কিছু এলাকা মুক্ত করে সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান