বিজ্ঞাপন
default-image

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ গৌরীপুরের যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর সেখানে ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। গৌরীপুর সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার (তখন থানা) অন্তর্গত। কানাইঘাটে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত এক অবস্থান। প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল তাদের ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট।

জকিগঞ্জ, আটগ্রাম, চারগ্রাম দখলের পর মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে যেতে থাকেন সিলেট অভিমুখে। মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলে ছিলেন লিয়াকত আলী খান। ২৫ নভেম্বর তাঁরা কানাইঘাট থানা সদরের দুই মাইল অদূরে গৌরীপুরে পৌঁছান। তাঁরা ছিলেন কয়েকটি দলে বিভক্ত। কানাইঘাটে আক্রমণের উদ্দেশ্যে তাঁরা গৌরীপুরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন।

২৬ নভেম্বর ভোরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অতর্কিতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলকে (আলফা কোম্পানি) আক্রমণ করে। এ রকম অবস্থায় পাল্টা আক্রমণ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। মুক্তিযোদ্ধারা সাহসের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ মোকাবিলা করতে থাকেন। কিন্তু বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করার পরও তাঁদের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। আক্রান্ত মুক্তিযোদ্ধা দলের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান (বীর উত্তম) একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শাহাদাতবরণ করেন। এ অবস্থায় লিয়াকত আলী খান যুদ্ধক্ষেত্রে অধিনায়কের দায়িত্ব পান।

এই যুদ্ধের বর্ণনা আছে ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহম্মদের (বীর বিক্রম, পরে মেজর) ভাষ্যে। তিনি বলেন, ‘ভোরে পাকিস্তানি ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট আমাদের “এ” কোম্পানির পজিশনের ওপর আক্রমণ করে। “এ” কোম্পানি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে পাকিস্তানি আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়।’

‘এ যুদ্ধে শত্রুপক্ষের একজন মেজর, একজন ক্যাপ্টেনসহ ১০০ জন সৈন্য নিহত হয়। আমাদের পক্ষে ক্যাপ্টেন মাহবুবসহ ১০-১১ জন শহীদ এবং প্রায় ২০ জন আহত হন। ক্যাপ্টেন মাহবুব শহীদ হওয়ার পর তদস্থলে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত আলী ওই কোম্পানির কমান্ডার নিযুক্ত হন। তিনি সাবেক পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের পাইলট ছিলেন। এ ধরনের পদাতিক যুদ্ধে তাঁর কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। একটু পরে তিনি শত্রুর বুলেটে আহত হন। আহত অবস্থায়ই তিনি অনেকক্ষণ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।’

লিয়াকত আলী খান ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মে মাসের শেষে বাবার অসুস্থতার কথা বলে বাংলাদেশে আসেন। কয়েক দিন পর ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। কিছুদিন পর তাঁকে নিয়মিত বাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

লিয়াকত আলী খানকে ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থানের ঘটনায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। পরে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি করেন। এরপর বাংলাদেশ বিমানে বৈমানিক হিসেবে চাকরি নেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান