বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালে দিনাজপুর ইপিআর সেক্টরের ৯ উইংয়ে (বর্তমানে ব্যাটালিয়ন) কর্মরত ছিলেন লিলু মিয়া। তাঁর পদবি ছিল ল্যান্স নায়েক। উইং হেডকোয়ার্টার্সের অবস্থান ঠাকুরগাঁও শহরে। ২৬ মার্চ সকাল থেকে হাজার হাজার মানুষ ঠাকুরগাঁও শহরের রাজপথে বেরিয়ে পড়ে। তাঁরা সড়কে ব্যারিকেড দেয় এবং বাঙালি ইপিআরদের আহ্বান জানায় তাদের সঙ্গে যোগ দিতে।

২৮ মার্চ রাতে (ঘড়ির কাঁটা অনুসারে ২৯ মার্চ) লিলু মিয়াসহ বাঙালি ইপিআর সেনারা বিদ্রোহ করেন। উইংয়ে বাঙালি-অবাঙালি ইপিআরদের মধ্যে ৩০ মার্চ পর্যন্ত সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে বেশির ভাগ অবাঙালি ইপিআর ও পাকিস্তানি সেনা (প্রায় ১১৫ জন) নিহত হয়।

এরপর ইপিআর মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। তাঁরা বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন। একটি দল ভাতগাঁও (ঠাকুরগাঁও থেকে ২৩ মাইল আগে), একটি দেবীগঞ্জে, একটি দল শিবগঞ্জে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করে। এ ছাড়া ঠাকুরগাঁও-সৈয়দপুরের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী বিভিন্ন সড়কের খানসামা, জয়গঞ্জ ও ঝাড়বাতিতেও তাঁরা প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলেন।

প্রতিরোধযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের এসব প্রতিরক্ষার একটির সঙ্গে আরেকটির ফিল্ড টেলিফোন বা ওয়্যারলেস যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল না। ফলে তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগে অসুবিধা হয়। একমাত্র রানারই ছিল যোগাযোগের মাধ্যম। তখন কখনো কখনো এ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় নির্ভীক, অকুতোভয় ও কৌশলী লিলু মিয়াকে। তিনি যুদ্ধের পাশাপাশি এই দায়িত্বও সাহসের সঙ্গে পালন করেন।

এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। একদিন লিলু মিয়া এই দায়িত্ব পালনকালে একটি মোটরসাইকেল নিয়ে এক প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে আরেক প্রতিরক্ষা অবস্থানে যাচ্ছিলেন। পথে দিনাজপুর-সৈয়দপুর সড়কের ১০ মাইল নামক জায়গায় তিনি আক্রান্ত হন। ১০ মাইলেও ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রবল আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েক দিন আগে অনেক ক্ষতি স্বীকার করে ওই প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে যান।

এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের এক প্রতিরক্ষা থেকে আরেক প্রতিরক্ষা অবস্থানে খবর পৌঁছাতে হতো ওই এলাকা দিয়েই। ১০ মাইল এলাকায় পাকিস্তানি সেনা মোতায়েন ছিল। আকাশেও মাঝেমধ্যে চক্কর দিয়ে বেড়ায় পাকিস্তানি হেলিকপ্টার। লিলু মিয়া এতে দমে যাননি। ভয়ও পাননি। নির্ভয়ে এগিয়ে যান ওই এলাকা দিয়ে। কিন্তু সফল হননি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে লক্ষ্য করে গোলাগুলি শুরু করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং শহীদ হন তিনি।

শহীদ লিলু মিয়ার মরদেহ তাঁর সহযোদ্ধারা সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার করতে পারেননি। পরে তাঁর মরদেহ স্থানীয় গ্রামবাসী সেখানেই সমাধিস্থ করেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান