বিজ্ঞাপন
default-image

‘স্বাধীনতার এত বছর পর মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনতে এই প্রথম কেউ আমার বাড়িতে এল। খুব ভালো লাগছে। আমার প্রাণে আবার শক্তি সঞ্চারিত হলো। আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম মায়ের প্রেরণায়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে মা আমাকে একদিন বললেন, “রফিকুল, এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে বীরের মতো বেঁচে থাকা ভালো। তুই যুদ্ধে চলে যা। দেশকে শত্রুমুক্ত কর।” মা আমাকে উত্সর্গ করেন দেশের জন্য। এরপর আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চলে যাই ভারতে। তখন আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র। বয়স ১৮-১৯।’ রফিকুল ইসলাম আবেগঘন কণ্ঠে কথাগুলো বললেন।

রফিকুল ইসলাম ভারতের বিহার রাজ্যের চাকুলিয়ায় প্রশিক্ষণ নিয়ে ৯ নম্বর সেক্টরের টাকি সাব-সেক্টর এলাকায় যুদ্ধ করেন। প্রথম অপারেশনে অংশ নেন আগস্টের শেষ দিকে। আগস্টের ২০ তারিখে টাকি থেকে তিনিসহ ১২০ জন মুক্তিযোদ্ধা বরিশালের উজিরপুরের হাবিবপুরে এসে ক্যাম্প করেন।

চার-পাঁচ দিন পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল পার্শ্ববর্তী হাটতারা বাজারে আসে। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় তারা বাজার ও পার্শ্ববর্তী বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে নির্বিচারে লুটতরাজ করতে থাকে। খবর পেয়ে তাঁরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওই দল ও তাদের সহযোগী রাজাকারদের ওপর পাল্টা আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের এই আক্রমণের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তাঁদের আকস্মিক এ আক্রমণে ছয়জন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার আহত হয়। তাঁরা মর্টারগান দিয়ে গোলাবর্ষণ করার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা লঞ্চযোগে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে রফিকুল ইসলাম যথেষ্ট সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দেন।

এরপর রফিকুল ইসলাম বাবুগঞ্জ থানা অপারেশনে অংশ নেন। তখন তাঁদের দলের অবস্থান ছিল স্বরূপকাঠি থানার বিন্নাকাঠিতে। সেপ্টেম্বরের শেষ বা অক্টোবরের প্রথম দিকে এক দিন তাঁরা রাতের অন্ধকারে বিন্নাকাঠি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বাবুগঞ্জে গিয়ে সেখানকার থানায় আক্রমণ চালান। বাবুগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারাও এ যুদ্ধে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। সেখানে নানা কৌশলে তাঁরা যুদ্ধ করেন। সম্মুখযুদ্ধে তাঁদের ১৭ জন আহত হন। প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েও বাবুগঞ্জ তাঁরা মুক্ত করতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা তাদের বাবুগঞ্জের অবস্থান ধরে রাখে। পরে এখানে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে তাঁদের আরেকটি বড় যুদ্ধ হয়। এরপর তারা বানারীপাড়া ও উজিরপুর থেকে পশ্চাদপসরণ করে বাবুগঞ্জে গিয়ে অবস্থান নেয়। ফলে বাবুগঞ্জে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বাবুগঞ্জের যুদ্ধে রফিকুল ইসলামদের দলের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর আরও কয়েকটি দল অংশ নেয়। তাঁদের প্রচণ্ড আক্রমণের জবাবে পাকিস্তানি সেনারাও গোলাগুলির মাধ্যমে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাবুগঞ্জে যুদ্ধ চলে কয়েক দিন। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর কাছে পরাজিত হতে বাধ্য হয়। রফিকুল ইসলাম আরও কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। এর মধ্যে বড়কোটা গ্রাম, স্বরূপকাঠির বিন্না ও বরিশাল শহরের আক্রমণ উল্লেখযোগ্য।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান