সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে মোহাম্মদ হাফিজ নিঃশব্দে পৌঁছালেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের কাছে। উপস্থিতি টের পেয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আক্রমণ করল। মোহাম্মদ হাফিজ সহযোদ্ধাদের দ্রুত সংগঠিত করলেন। তাঁরা বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে লাগলেন। এ ঘটনা ঘটেছিল গোয়াইনঘাটে ১৯৭১ সালের ২৪ অক্টোবরে।
গোয়াইনঘাট সিলেট জেলার অন্তর্গত। ১৯৭১ সালে সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত এক প্রতিরক্ষা অবস্থান। এই প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ করার জন্য নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ২৩ অক্টোবর রাতে সেখানে সমবেত হয়। নদীর পূর্বপাড়ে আক্রমণের দায়িত্ব ছিল আলফা কোম্পানির। এই দলে ছিলেন মোহাম্মদ হাফিজ।
লেংগুরা গ্রামের দক্ষিণে ব্রিজহেড তৈরির মাধ্যমে সুরমা নদী অতিক্রম করে তাঁরা সেখানে পৌঁছান। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। পাকিস্তানিরা ভোররাতে (তখন ঘড়ির কাঁটা অনুসারে ২৪ অক্টোবর) আকস্মিকভাবে তাঁদের আক্রমণ করে। এ সময় মোহাম্মদ হাফিজ সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন। দুপুরের পর হেলিকপ্টারযোগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নতুন দল এসে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে। তাদের ফায়ার পাওয়ার ছিল খুবই শক্তিশালী। এই রকম এক চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে মোহাম্মদ হাফিজ তাঁর দলবল নিয়ে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ চলে। গোটা এলাকা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। কোনো কোনো স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতাহাতি যুদ্ধ পর্যন্ত হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ২২ জন শহীদ ও ৩০ জন আহত হন।
মোহাম্মদ হাফিজ তাঁর এক লেখায় এই যুদ্ধের স্মৃতিচারণা করে লিখেছেন: ‘...দুপুর ১২টার দিকে শত্রুরা আমাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। এ সময় অসংখ্য পাকিস্তানি সেনা আচমকা পেছন দিক থেকে এসে ‘হ্যান্ডসআপ’ বলে চিত্কার করে ওঠে। আমি বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে তাত্ক্ষণিক শত্রুর দিকে এলোপাতাড়ি ব্রাশফায়ার করি। আমার সঙ্গে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ত্রিমুখী আক্রমণ খুবই সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেন। আমরা সবাই শত্রুর বেষ্টনী থেকে বের হয়ে আসতে সক্ষম হই। সে দিনের ঘটনাটি ছিল আমার মুক্তিযুদ্ধ জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা।’
মোহাম্মদ হাফিজ চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালে রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে। তিনি ছিলেন আলফা কোম্পানিতে। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েব সুবেদার। মার্চ মাসে তাঁরা ছিলেন দিনাজপুরের পার্বতীপুরে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তাতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে যুদ্ধ করেন জেড ফোর্সের অধীনে।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান