বিজ্ঞাপন
default-image

ভারতের তেলিয়ামুড়া থেকে রাতে আকাশে ডানা মেলে দিল একটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার। তাতে দুজন পাইলট ও একজন গানার। পাইলট সুলতান মাহমুদ (বীর উত্তম, পরে এয়ার ভাইস মার্শাল ও বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান) ও বদিউল আলম (বীর উত্তম, পরে স্কোয়াড্রন লিডার)। গানারের নাম মো. শহীদুল্লাহ। গন্তব্য নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল। হেলিকপ্টারটি রাতের অন্ধকারে কুমিল্লা-ঢাকা মহাসড়ক লক্ষ্য করে দাউদকান্দির দিকে অগ্রসর হয়। তারপর দ্রুত ঢাকার ডেমরার কাছে এসে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দক্ষিণে গোদনাইলের দিকে রওনা হয়। লক্ষ্যস্থলের কাছে যাওয়ামাত্র মো. শহীদুল্লাহ তেলের ট্যাংকার লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করেন। মুহূর্তেই ট্যাংকারগুলো বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। চোখের পলকে আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে আকাশ। বিস্ফোরণের শব্দে জেগে ওঠা মানুষ ও পাকিস্তানি সেনারা অবাক বিস্ময়ে দেখে সেই আগুনের লেলিহান শিখা। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতের ঘটনা এটি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই অপারেশন এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করে। এত দিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনী জলে-স্থলে আক্রমণ চালিয়েছে, এবার ব্যতিক্রম ঘটল। মুক্তিবাহিনীর বিমান উইং গঠিত হওয়ার পর অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে পাকিস্তানি সেনারা ত্রিমুখী আক্রমণের শিকার হতে থাকে। ৩ ডিসেম্বর দুটি জায়গায় একযোগে আক্রমণ পরিচালিত হয়—চট্টগ্রামে ইস্টার্ন রিফাইনারি-সংলগ্ন তেল ডিপো ও গোদনাইলের তেল ডিপোতে। এ দুই ডিপোতে পাকিস্তানি সেনারা বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল যুদ্ধের জন্য মজুদ করে রেখেছিল। এসব ডিপো থেকে তাদের স্থল, নৌ ও আকাশযানের জন্য জ্বালানি সরবরাহ করা হতো। মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকবার চেষ্টা করেও তেল ডিপোর ক্ষতি সাধনে ব্যর্থ হন। সেদিনের আক্রমণে তেল ডিপো দুটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং বেশির ভাগ জ্বালানি পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। এতে পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল ভেঙে পড়ে।

মো. শহীদুল্লাহ চাকরি করতেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন ঢাকায়। ২৫ মার্চ রাতে তিনি কুর্মিটোলায় ছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেন। বাঙালি সহকর্মী ওয়ারেন্ট অফিসার মজিদসহ একজনকে পাকিস্তানি সেনারা তাঁর চোখের সামনেই গুলি করে হত্যা করে। কয়েক দিন পর তিনি ঢাকা থেকে পালিয়ে নিজ এলাকায় গিয়ে স্থানীয় প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। পরে ভারতে চলে যান। ভারতের আগরতলায় থাকার সময় তিনি মুক্তিবাহিনীর নবগঠিত বিমান উইংয়ে যোগ দেন। এখানে যোগ দেওয়ার আগে আগরতলায় মুক্তিবাহিনীর একটি ক্যাম্পে সংগঠক ও প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন। ভারত সরকার সেপ্টেম্বরে মুক্তিবাহিনীকে তিনটি বিমান দেয়। একটি ডিসি ৩ বা ডাকোটা, একটি অটার ও অন্যটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার। এর মধ্যে শেষের দুটি যুদ্ধবিমানের উপযোগী ছিল না। মো. শহীদুল্লাহসহ কয়েকজন বিমান দুটিকে যুদ্ধের উপযোগী করে তোলেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান