বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর নৌ-উইংয়ের দুটি গানবোট ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ ভারত থেকে নৌপথে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ অভিমুখে। একটি গানবোটে ছিলেন মো. মহিবুল্লাহ। তিনি ছিলেন কামানের ক্রুম্যান।

পরে মিত্রবাহিনীর দুটি রণতরি আইএনএস ‘প্যানভেল’ (গানবোট) ও ‘চিত্রাঙ্গদা’ (প্যাট্রোল ক্রাফট) তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয়।

১০ ডিসেম্বর ভোরে সব রণতরি নোঙর তুলে মংলার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। কোনো বাধা ছাড়াই সকাল সাড়ে সাতটায় তাঁরা মংলায় পৌঁছান। সকাল নয়টায় শুরু হয় তাঁদের চূড়ান্ত অভিযান। সামনে ‘প্যানভেল’, মাঝে ‘পলাশ’, শেষে ‘পদ্মা’। ‘চিত্রাঙ্গদা’ মংলায় থেকে যায়।

রণতরিগুলো যখন খুলনার পাকিস্তানি নৌঘাঁটির কাছাকাছি, তখন আনুমানিক বেলা সাড়ে ১১টা। এ সময় আকাশে দেখা যায় তিনটি জঙ্গিবিমান। শত্রুবিমান মনে করে মো. মহিবুল্লাহরা বিমানবিধ্বংসী কামানের গোলা বর্ষণ করতে উদ্যত হন। কিন্তু ‘প্যানভেল’ গানবোট থেকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে তাঁদের গানবোটে জানানো হয়, ওগুলো ভারতীয় বিমান।

এরপর বিমানগুলো কিছুটা নিচে নেমে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে চলে যায়। ১০ মিনিট পর হঠাত্ ঘুরে এসে বোমা বর্ষণ করে ‘পদ্মা’র ওপর। পরক্ষণেই ‘পলাশে’। যদিও গানবোটগুলো মুক্তি, নাকি মিত্রবাহিনীর, তা শনাক্ত করার জন্য ছাদে ১৫ ফুট লম্বা এবং ১০ ফুট চওড়া হলুদ কাপড় বিছানো ছিল। তার পরও এই দুর্ঘটনা ঘটে। ‘প্যানভেল’ গানবোটে বিমান বোমা বর্ষণ করেনি। তখন সেটি বেশ এগিয়ে ছিল।

বোমার আঘাতে দুই গানবোটেই আগুন ধরে যায়। দুটিতে ৫৬ জন নৌযোদ্ধা ছিলেন। বিপদ আন্দাজ করে কেউ কেউ আগেই পানিতে ঝাঁপ দেন। তাঁদের বেশির ভাগই অক্ষত থাকেন। কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মো. মহিবুল্লাহসহ যাঁরা রণতরিতে ছিলেন, তাঁরা শহীদ হন, নয়তো মারাত্মকভাবে আহত হন। মো. মহিবুল্লাহ প্রথম বিমান হামলাতেই শহীদ হন।

ঘটনার এখানেই শেষ নয়। পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়া নৌ-মুক্তিযোদ্ধারা সাঁতরে নদীর পাড়ে এলে অনেককে পাকিস্তানি সেনা এবং সহযোগী রাজাকাররা তাদের আটক করে। কয়েকজনকে তারা সঙ্গে সঙ্গে হত্যা এবং বাকিদের নির্যাতন করার পর জেলে পাঠায়।

১৮ ডিসেম্বর নৌ-মুক্তিযোদ্ধারা ধ্বংসপ্রাপ্ত গানবোট থেকে দুটি মরদেহ উদ্ধার করেন। এর মধ্যে একটি ছিল শহীদ মো. মহিবুল্লাহর। আট দিনে তাঁর মরদেহ শুকিয়ে হাড়ের সঙ্গে কেবল চামড়া লেগে ছিল। তার পরও সহযোদ্ধাদের তাঁর মরদেহ চিনতে কষ্ট হয়নি।

পাকিস্তানি নৌবাহিনীর সাবেক ক্রুম্যান (এবি) মো. মহিবুল্লাহ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রতিরোধযুদ্ধে শেষে ভারতে যান। পরে তাঁকে মুক্তিবাহিনীর নৌ-উইংয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান