বিজ্ঞাপন
default-image

কুড়িগ্রাম জেলার উত্তরে ভুরুঙ্গামারী। এর তিন দিকেই ভারত। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালায় ভুরুঙ্গামারীর পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে। এখানে নিয়োজিত ছিল পাকিস্তানি সেনাদের মিশ্র এক বাহিনী। নিয়মিত সেনা, ইপিসিএএফ ও স্থানীয় রাজাকার।

পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, ১২ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী প্রথমে আক্রমণ চালায় পাটেশ্বরীতে। মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে বিভক্ত ছিলেন। একটি দলের নেতৃত্ব দেন মো. বদরুজ্জামান মিয়া। তাঁরা একযোগে আক্রমণ চালিয়ে পাটেশ্বরী দখল করে নেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হন ভুরুঙ্গামারীর পূর্ব পাশে। সেখান থেকে তাঁরা গোলাগুলি শুরু করেন। পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা জবাব দেয়।

পরদিন ১৩ নভেম্বর সকাল থেকে মিত্রবাহিনী কামানের সাহায্যে গোলাবর্ষণ শুরু করে। তাদের যুদ্ধবিমানও কয়েকবার ভুরুঙ্গামারীর আকাশে চক্কর দিয়ে গোলাবর্ষণ করে। এর ছত্রচ্ছায়ায় মো. বদরুজ্জামান মিয়া ও তাঁর সহযোদ্ধারা এগিয়ে যান পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানের সাত-আট শ গজের মধ্যে। পাকিস্তানি সেনারা মরিয়া হয়ে তাঁদের আক্রমণ প্রতিরোধ করে। একপর্যায়ে তাঁরা অবস্থান নেন পাকিস্তানি প্রতিরক্ষাব্যূহের চার-পাঁচ শ গজের মধ্যে।

মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ ছিল ত্রিমুখী। মো. বদরুজ্জামান মিয়ার দল এক দিক থেকে এবং অপর দুই দল অন্য দুই দিক থেকে আক্রমণ চালায়। এতে পাকিস্তানি সেনা, ইপিসিএএফ ও রাজাকাররা দিশাহারা হয়ে পড়ে। মধ্যরাত পর্যন্ত পাকিস্তানি অবস্থান থেকে থেমে থেমে গোলাগুলি অব্যাহত ছিল। এরপর গোলাগুলি কমে যেতে থাকে। সকাল হওয়ার আগেই তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।

১৪ নভেম্বর খুব ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ভুরুঙ্গামারীতে ঢুকে পড়েন। সিও অফিস ও হাইস্কুলের কাছে পৌঁছে তাঁরা দেখেন, পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেও গোলাগুলি করেনি। কারণ, তাদের অস্ত্রের গুলি শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরে তারা আত্মসমর্পণ করে। সিও অফিসের কাছে ছড়িয়ে ছিল ৪০-৪৫ জন পাকিস্তানি সেনার লাশ। একটি বাংকারেও পাওয়া যায় এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের লাশ।

মো. বদরুজ্জামান মিয়া ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ছিলেন। ১ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল লালমনিরহাট হয়ে ধরলা নদী পেরিয়ে কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী অভিমুখে আসে। তখন ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের সমন্বয়ে গড়া মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করেন। এই যুদ্ধে মো. বদরুজ্জামান মিয়া সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং গুরুত্বপূর্ণ নানা দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে যুদ্ধ করেন ৬ নম্বর সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাবসেক্টরে।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান