মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ। সীমান্তের ওপারে যখন এই খবর এল, তখন রাত। মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে চরম উত্তেজনা। অবরুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্ধারের দায়িত্ব পড়ল স্পেশাল প্লাটুনের ওপর। গভীর রাতেই ভারতের বেতাই থেকে মুক্তিযোদ্ধারা রওনা হলেন বাংলাদেশ অভিমুখে। মাথাভাঙ্গা নদী পার হয়ে তাঁরা ধর্মদহের চরে নামলেন। নদীর পশ্চিম পাশে বেতাই। মো. খলিলুর রহমানসহ (ওয়াহিদুর রহমান) মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২৫ জন।
মুক্তিযোদ্ধারা দুটি দলে বিভক্ত হলেন। একটি দলের নেতৃত্বে থাকলেন মো. খলিলুর রহমান। অপর দলের নেতৃত্বে আবুল খায়ের। মো. খলিলুর রহমান সহযোদ্ধাদের নিয়ে নদীতে নেমে স্রোতের অনুকূলে সাঁতরে প্যারাকপুর রওনা হলেন। এই পথ বেশ বিপজ্জনক। প্যারাকপুরে নদীর পাড় ঘেঁষে আছে দুটি বাংকার। পাকিস্তানি সেনারা ওই বাংকারে অবস্থান করে ২৪ ঘণ্টা নদীপথের দিকে কড়া নজর রাখে।
তখন ভোরবেলা। ঠিক সেই সময় মো. খলিলুর রহমান তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে পৌঁছালেন ওই বাংকারের কাছে। মুক্তিযোদ্ধারা নদী থেকে নিঃশব্দে তীর বেয়ে উঠে অতর্কিতে হামলা চালালেন বাংকারে। কোনো গুলি খরচ নয়, বেয়নেট চার্জ করে তাঁরা হত্যা করলেন বাংকারে থাকা পাকিস্তানি রক্ষীদের। প্যারাকপুরে ছিল অল্প কয়েকজন পাকিস্তানি। একই কায়দায় মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরও ঘায়েল করলেন। পাকিস্তানি সেনারা প্রতিরোধের কোনো সুযোগই পেল না।
ওদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অপর দলটি মহেশকুন্ডিতে আক্রমণ করে বসে। একটু পর খলিলুর রহমান সহযোদ্ধাদের নিয়ে পেছন দিক দিয়ে সেখানে এসে একইভাবে আক্রমণ চালান। তখন সকাল হয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বিমুখী আক্রমণে হতাহত হলো অনেক পাকিস্তানি সেনা।
মহেশকুন্ডিতে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগীদের সংখ্যা ছিল অনেক। তাদের পাল্টা আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদেরও বেশ ক্ষয়ক্ষতি হলো। এতে খলিলুর রহমান ও তাঁর সহযোদ্ধারা দমে গেলেন না। সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করে আটকে পড়া বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধাকে উদ্ধার করেন। তাঁদের সাহসিকতায় বেঁচে যায় অনেক প্রাণ।
মহেশকুন্ডির যুদ্ধ ছিল উল্লেখযোগ্য এক লড়াই। সেদিনকার যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অনেক পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী নিহত হয়। অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে আনোয়ার হোসেন খান, মজিদ মোল্লা (ফরিদপুর) ও আনোয়ার আলীসহ কয়েকজন শহীদ হন।
মো. খলিলুর রহমান চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন চুয়াডাঙ্গা ইপিআর উইংয়ের অধীনে মেহেরপুর সীমান্তে। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে যুদ্ধ করেন ৮ নম্বর সেক্টরের লালবাজার ও শিকারপুর সাবসেক্টরে। তিনি প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান