বিজ্ঞাপন
default-image

ফেনী জেলার পরশুরাম ও ফুলগাজী থানা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দুই থানার বিভিন্ন জায়গায় ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘাঁটি। অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন দল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘাঁটিগুলোয় একের পর এক আক্রমণ চালাতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর একটি দলে ছিলেন মো. ইদ্রিস। মুক্তিবাহিনীর তত্পরতা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২৭ অক্টোবর চিথলিয়ায় ব্যাপক সেনাসমাবেশ ঘটায়। তাদের লক্ষ্য ছিল মুক্তিবাহিনীর দলগুলো ধ্বংস করা। সন্ধ্যার দিকে গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুটি কোম্পানি মুক্তিবাহিনীর অগ্রবর্তী ঘাঁটি নিলক্ষ্মীর ওপর আক্রমণ চালায়। মো. ইদ্রিসসহ তাঁর সহযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। কয়েক ঘণ্টা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেও পাকিস্তানি সেনাদের প্রচণ্ড আক্রমণে তাঁরা নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের ঘাঁটি দখল করে।

মো. ইদ্রিস ও তাঁর সহযোদ্ধারা পরদিন সংগঠিত হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ করেন। মুক্তিবাহিনী এবার সংখ্যায় ছিল তিন কোম্পানি। গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তাও পান তাঁরা। ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর নিলক্ষ্মী ঘাঁটি ত্যাগ করে পিছিয়ে যায়। মো. ইদ্রিস ও তাঁর সহযোদ্ধারা নিলক্ষ্মী ঘাঁটি দখলের পর তাঁদের প্রতিরক্ষাব্যূহ গাবতলী ও মালিবিল পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেন। পরদিন সন্ধ্যায় তাঁদের একটি দল ফেনী-বিলোনিয়া পথের এক জায়গায় অ্যামবুশ পেতে বসে থাকে। পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল বিলোনিয়া যাওয়ার পথে সেই অ্যামবুশে পড়ে। আক্রমণে ১৩ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা দুজন পাকিস্তানি সেনাকে বন্দী করেন, হস্তগত করেন অনেক অস্ত্রশস্ত্র।

পাকিস্তানি সেনারা নিলক্ষ্মীতে পাতা অ্যামবুশে পর্যুদস্ত হওয়ার পর ২৯ অক্টোবর ভোর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর আবার পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। এবার তারা আক্রমণ পরিচালনা করে শালধর, নয়াপুর ও ফুলগাজীর দিক থেকে। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর কামানের ব্যাপক গোলাবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিবাহিনীর কামানগুলোও পাল্টা গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এ সময় শালধর, নয়াপুর ও ফুলগাজীতে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। মো. ইদ্রিস ও তাঁর দলের সদস্যরা শালধরে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। অন্যান্য স্থানের মুক্তিযোদ্ধারাও পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলা করে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন। মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে আক্রমণ শুরু করলে পাকিস্তানি সেনারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। দুপুরের পর থেকে তারা পালাতে শুরু করে। সেদিন যুদ্ধে প্রায় ৪০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও অসংখ্য আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর দুজন শহীদ ও কয়েকজন আহত হন।

মো. ইদ্রিস কর্মরত ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালের মার্চে তিনি ছুটিতে ছিলেন। তিনি প্রতিরোধযুদ্ধে যোগ দেন। পরে ২ নম্বর সেক্টরের রাজনগর সাব-সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন। চিথলিয়ার যুদ্ধে তিনি আহত হন।

মো. ইদ্রিস ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান