বিজ্ঞাপন
default-image

রাতে যুদ্ধবিরতি। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাত। মাঝেমধ্যে ভেসে আসছে ঝিঁঝি পোকার ডাক। মো. আশরাফ আলী খানসহ পরিশ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্রাম নিচ্ছেন। তিনি একটি উপদলের (প্লাটুন) দলনেতা। সবাই সতর্ক অবস্থায়। কেউ আধা ঘুমে, কেউ জেগে। শেষ রাতে তাঁদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে আকস্মিক আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি সেনারা।

নিমেষে শুরু হয়ে যায় তুমুল যুদ্ধ। মো. আশরাফ আলী খানসহ মুক্তিযোদ্ধারা এতে বিচলিত হননি। সাহসের সঙ্গে তাঁরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আকস্মিক আক্রমণ মোকাবিলা করেন।

সকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা প্রচণ্ডভাবে বেড়ে যায়। মুহুর্মুহু শেল ও রকেট এসে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে। শেল ও রকেটের স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ক্রমে বাড়ে।

আক্রমণের প্রচণ্ডতায় আশরাফ আলী খানের সহযোদ্ধারা কিছুটা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েন। তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে সহযোদ্ধাদের মনে সাহস জুগিয়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় সহযোদ্ধারা পুনরায় সংগঠিত ও অনুপ্রাণিত হয়ে সাহসের সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ চালান। তাঁদের বীরত্বে থেমে যায় বেপরোয়া পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রযাত্রা। তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে। একপর্যায়ে হতোদ্যম পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে শুরু করে। এ সময় পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া একঝাঁক গুলি ছুটে আসে মো. আশরাফ আলী খানের দিকে। কয়েকটি গুলি লাগে তাঁর শরীরে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। সহযোদ্ধারা উদ্ধার করার আগেই নিভে যায় তাঁর জীবনপ্রদীপ।

এ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে। আজমপুরে। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর। ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথে আখাউড়া রেলজংশনের কাছে আজমপুর রেলস্টেশনের অবস্থান।

৩০ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই এলাকায় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি দল এ যুদ্ধে অংশ নেয়। সেদিন দিনব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুক্ত হয় আজমপুর রেলস্টেশনসহ বিরাট এক এলাকা। পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের দিকে। তবে যুদ্ধে আশরাফ আলী খান, তাঁর অধিনায়ক (কোম্পানি কমান্ডার) লেফটেন্যান্ট ইবনে ফজল বদিউজ্জামানসহ (বীর প্রতীক) আটজন শহীদ হন। যুদ্ধ চলাকালেই সহযোদ্ধারা তাঁকে সমাহিত করেন আজমপুর রেলস্টেশনের পাশেই। তাঁর সমাধি সংরক্ষিত।

মো. আশরাফ আলী খান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল জয়দেবপুর রাজবাড়িতে। ২৫ মার্চের পর মেজর কে এম সফিউল্লাহর (বীর উত্তম, পরে সেনাপ্রধান, মেজর জেনারেল ও রাষ্ট্রদূত) নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। তিনি বি কোম্পানির একটি প্লাটুনের দলনেতা ছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান