বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালের জুনের একদিন। ফখরুদ্দীন চৌধুরীর নেতৃত্বে নৌকাযোগে জলপথে রওনা হলেন একদল মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা মাত্র দিন কয়েক আগে প্রশিক্ষণ শেষ করেছেন। সেদিন যাচ্ছিলেন জীবনের প্রথম অপারেশনে। উত্তেজনায় সবাই টগবগ করছেন। নৌকা ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। মাঝপথে হঠাৎ ঘটল অন্য বিপত্তি। মাঝি ভয় পেয়ে নৌকা থেকে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে গেল। তখন রাত আনুমানিক সাড়ে তিনটা। তাঁরা কেউ নৌকা চালাতে জানেন না। মাঝিবিহীন নৌকা তখন দুলছিল। যেকোনো সময় সেটা ডুবে গিয়ে তাঁদের সলিলসমাধি ঘটাতে পারে। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে অপারেশনে যাওয়া তো দূরের কথা, এখন জীবন বাঁচানোই মুখ্য কাজ হয়ে দাঁড়াল। শেষে তাঁরা নিজেরাই কোনো রকমে নৌকা চালিয়ে পশ্চাদপসরণ করলেন। এভাবেই ব্যর্থ হয়ে যায় তাঁদের প্রথম অপারেশন।

প্রথম অপারেশন ব্যর্থ হলেও জুনের শেষ দিক থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাঁরা বেশ কটি সফল অপারেশন পরিচালনা করেন। এসব অপারেশনে ফখরুদ্দীন চৌধুরী যথেষ্ট সাহস ও দক্ষতার পরিচয় দেন। একটি অপারেশনে তাঁরা কিছুটা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েন। তেলিখাল অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে তাঁদের দলের কয়েকজন শহীদ ও বেশ কয়েকজন আহত হন। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফখরুদ্দীন চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অ্যামবুশ, ডিমোলিশন ও আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেন।

এরপর ফখরুদ্দীন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন দলকে সংযুক্ত করা হয় নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল ডেল্টা কোম্পানির সঙ্গে। ডেল্টা কোম্পানির সঙ্গে ছাতক, গোয়াইনঘাট, গোবিন্দগঞ্জসহ বেশ কটি সম্মুখযুদ্ধে তিনি তাঁর দলসহ অংশ নেন। গোবিন্দগঞ্জ টি জংশন ও লামাকাজি ঘাটে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলতে ফখরুদ্দীন চৌধুরী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সিলেট শহর থেকে পশ্চিম দিকে লামাকাজি ঘাট। এর পশ্চিমে গোবিন্দগঞ্জ টি জংশন। এখান থেকে একটি রাস্তা চলে গেছে ছাতকের দিকে। অন্যটি সুনামগঞ্জের দিকে। এখানেই ছিল সিলেট শহরকে রক্ষা করার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সর্বশেষ প্রতিরক্ষাব্যূহ। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে সুনামগঞ্জ ও ছাতক থেকে পশ্চাদপসরণ করে পালিয়ে আসা পাকিস্তানি সেনারা অবস্থান নেয় এখানে। ১৪ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে আক্রমণ করে গোবিন্দগঞ্জে। এ সময় ফখরুদ্দীন চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেন গোবিন্দগঞ্জ টি জংশনের দক্ষিণে। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর গোবিন্দগঞ্জ টি জংশন সকালের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।

ফখরুদ্দীন চৌধুরী ১৯৭১ সালে একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করতেন। কর্মরত ছিলেন চট্টগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সেখানে প্রতিরোধযুদ্ধে যোগ দেন। পরে নিজের এলাকা হয়ে ভারতে চলে যান। সেখানে মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখানোর পর ইকো-১ প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নেন। জুন থেকে ৫ নম্বর সেক্টরভুক্ত হয়ে তিনি অপারেশন শুরু করেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান