বিজ্ঞাপন
default-image

রামপুরা ডিআইটি সড়ক থেকে তিনটি রিকশা রওনা হয় উলনের পথে। আলো নেই। অসমান কাঁচা রাস্তা। সামনের কিছু দূর যাওয়ার পর গোলাম দস্তগীর গাজী ও নীলু পেছনে তাকিয়ে দেখেন বাকি দুই রিকশা নেই। নানা ঘটনার পর তাঁরা আবার একত্র হয়ে রওনা হন। একসময় দৃষ্টিগোচর হয় লক্ষ্যস্থল উলন বিদ্যুৎকেন্দ্র (সাবস্টেশন) আলো।

রওনা হওয়ার সময় তাঁরা ঠিক করে রেখেছিলেন, লক্ষ্যস্থলের কাছাকাছি যাওয়ার পর প্রথম রিকশা আগে বিদ্যুৎকেন্দ্র ফটকে যাবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় রিকশায় থাকা মুক্তিযোদ্ধারা ফটকের কাছাকাছি পৌঁছে চালককে দাঁড়াতে বলবেন। চালকেরা তাঁদের চালাকি বুঝতে পারেননি বা কাউকে চিনতেও পারেননি। প্রথম রিকশা আগে ফটকের সামনে যায়।

ফটকে তখন পাহারায় ছিল একজন রাইফেলধারী পুলিশ ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের একজন নিরাপত্তা প্রহরী। তারা দুজন রিকশা দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। গোলাম দস্তগীর গাজী ও নীলু ক্ষিপ্রতার সঙ্গে চলন্ত রিকশা থেকে লাফিয়ে নেমে চোখের পলকে তাদের দিকে স্টেনগান তাক করে ধরেন। তারপর নিচু গলায় গাজী বলেন, ‘হ্যান্ডস-আপ, খবরদার, চেঁচামেচি করবে না।’

গাজী ফটকে প্রহরারত পুলিশের কাছ থেকে জেনে নেন বাকি পুলিশ ও নিরাপত্তাকর্মীরা কে কোথায়। সে জানায়, ১৫-১৬ জন পুলিশ ও নিরাপত্তাকর্মী একটি বড় ঘরে রাতের খাবার খাচ্ছে। তাদের সবাইকে তাঁরা নিঃশব্দে আত্মসমর্পণ করান। তাদের নিরস্ত্র করে নীলু ও মতিন (দুই) পাহারায় থাকেন। গাজী ও মতিন (এক) স্টেনগান হাতে এগিয়ে যান ট্রান্সফরমারের দিকে।

ট্রান্সফরমার ছিল কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। প্রায় দোতলাসমান উঁচু ট্রান্সফরমার। অপারেটর রুমের ভেতর দিয়ে সেখানে যেতে হতো। গাজী, মতিন (এক) ও আরও দুই সহযোদ্ধা ভেতরে ঢুকে ট্রান্সফরমারের গায়ে পিকে (বিস্ফোরক) লাগান।

সেদিন ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা উপদলে বিভক্ত হয়ে ঢাকায় একযোগে কয়েকটি অপারেশন করেন। গোলাম দস্তগীর গাজীরা বিস্ফোরক লাগানোর কয়েক মিনিট পর দেখা যায়, বিদ্যুচ্চমকের মতো এক ঝলক আলো। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে গোটা রামপুরা এলাকা। তারপর নিকষ কালো অন্ধকারে আকাশে ফণা তুলে দাঁড়ায় আগুনের লেলিহান শিখা। ট্রান্সফরমার পুরোপুরি ধ্বংস ও ঢাকা শহরের একাংশে বিদ্যুত্ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এ ঘটনা ঘটে ১৯৭১ সালের ১৯ জুলাই।

গোলাম দস্তগীর গাজী ১৯৭১ সালে শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে যান। ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে ঢাকা শহরে বেশ কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন। অপারেশনে তিনি পুরোভাগে থাকতেন। তিনি যেসব অপারেশনে অংশ নিয়েছেন তার মধ্যে গ্যানিজ ও দাউদ পেট্রল পাম্প অপারেশন উল্লেখযোগ্য।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান