অন্ধকার রাত। ভারতের ডাউকি থেকে রওনা হলেন একদল মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের নেতৃত্বে খোরশেদ আলম। সীমান্ত অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে থাকলেন। তাঁদের লক্ষ্য গোয়াইনঘাটের একটি সেতু। সেখানে পাহারায় আছে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা। তাদের আক্রমণ করে তাড়িয়ে দিতে হবে। তারপর সেতু ধ্বংস করতে হবে। বিপজ্জনক ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ এক অপারেশন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা, বিশেষত খোরশেদ আলম তাঁর লক্ষ্য পূরণে পিছপা হননি। মধ্যরাতের আগেই তাঁরা নিঃশব্দে পৌঁছে যান লক্ষ্যস্থলে। একযোগে শুরু করেন আক্রমণ। পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা আক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টা করে। কিন্তু তাঁদের প্রচণ্ড সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে ভীতসন্ত্রস্ত রাজাকাররা আগেই পালিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে পালিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারাও। মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত সেতুতে মাইন লাগানোর কাজ শুরু করেন। মাইন লাগিয়ে অবস্থান নেন নিরাপদ দূরত্বে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারদিক প্রকম্পিত করে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় মাইন। ধ্বংস হয় সেতু। সফল হয় অপারেশন। এরপর তাঁরা ফিরে যান সীমান্তের ওপারে, নিজেদের ঘাঁটির দিকে।
গোয়াইনঘাট সিলেট জেলার অন্তর্গত। সীমান্তবর্তী থানা। গোয়াইনঘাটের ওপর দিয়েই রক্ষা করতে হয় সিলেট-তামাবিল-ডাউকি-শিলংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ। এ জন্য ১৯৭১ সালে গোয়াইনঘাট ছিল গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বিঘ্ন চলাচল ব্যাহত করার জন্য মুক্তিবাহিনী এই সেতুটি ধ্বংস করে। ওই সেতু ধ্বংসের কয়েক দিন আগে ভারতের একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা মুক্তিবাহিনীর ডাউকি ক্যাম্পে এসে বলেন, ‘এই অপারেশনে আপনারা কে যাবেন?’ তিনি এ কথা বলার পর কেটে যায় কয়েক মিনিট। মুক্তিযোদ্ধাদের দলনেতা সবাই চুপচাপ। শেষে হাত তোলেন সাহসী খোরশেদ আলম। এরপর তাঁকেই অপারেশন পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
খোরশেদ আলম চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন সিলেট ইপিআর হেডকোয়ার্টারের ১২ নম্বর উইংয়ের অধীনে সীমান্ত এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যোগ দেন প্রতিরোধযুদ্ধে। এপ্রিলের শেষে সিলেট শহর এলাকার শিবপুরে একটি প্রতিরক্ষা অবস্থানে থাকার সময় পাকিস্তানি সেনাদের বড় একটি দল তাঁদের আক্রমণ করে। ফলে বেধে যায় দুই পক্ষের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে খোরশেদ আলমের দলের ১৩ জন ছাড়া বাকি সবাই শহীদ হন। চরম এ বিপর্যয়েও তিনি মনোবল হারাননি। যুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের উদ্দেশ করে বলতে থাকে, ‘স্যারেন্ডার করো। তোমাদের ক্ষতি হবে না। প্রমোশন দেওয়া হবে।’ কিন্তু ওই প্রলোভনে পা দেননি তিনি। হাওরের ভেতর দিয়ে পালিয়ে যান। এরপর ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। ভারতে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার পর ৫ নম্বর সেক্টরের ডাউকি সাব-সেক্টর এলাকাজুড়ে তিনি যুদ্ধ করেন। ছাতক যুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দেন। ৭ ডিসেম্বর সেখানে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান