বিজ্ঞাপন
default-image

২৬ নভেম্বর ১৯৭১। সিলেট জেলার কানাইঘাট এলাকা। শীতের দিন। ভোর আনুমানিক সাড়ে চারটা বা পাঁচটা। চারদিকে সুনসান নীরবতা। এ সময় প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট অতর্কিতে আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেলটা কোম্পানির একাংশের ওপর। তাদের আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর ডেলটা কোম্পানির ১১ নম্বর প্লাটুন (এটি গৌরীপুরের সর্বদক্ষিণে ছিল) প্রায় বিধ্বস্ত হয়। এই প্লাটুনের নেতৃত্বে ছিলেন সুবেদার মুসা। তাঁর বাঁ দিকে কয়েক শ মিটার দূরের অবস্থানে ছিলেন লেফটেন্যান্ট ওয়াকার হাসান। তিনি ওয়্যারলেসে খবর পেয়ে ২৩-২৪ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ঝোড়োগতিতে ১১ নম্বর প্লাটুনের অবস্থানে এসে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালান। তিনি তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের নাকের ডগার মধ্যে ঢুকে পড়েন।

এ রকম অবস্থায় সম্মুখযুদ্ধ বা হাতাহাতি ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। ঘণ্টা কয়েক ধরে চলে তা। ওয়াকার হাসান ও তাঁর সহযোদ্ধাদের দুঃসাহস ও বীরত্বে পাকিস্তানি সেনারা শেষ পর্যন্ত কোণঠাসা হয়ে পড়ে। যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা যখন ব্যাপক হারে নিহত বা আহত হচ্ছিল, তখন তারা পালাতে থাকে। পালানোর সময় নিহত হয় ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর সারওয়ার। সেদিনের যুদ্ধে ওয়াকার হাসান অসাধারণ নৈপুণ্য ও বীরত্বের পরিচয় দেন। এ যুদ্ধে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের প্রায় ৮৮ জন সেনা নিহত এবং ২৬ জন বন্দী হয়।

কানাইঘাটে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত একটি ঘাঁটি। ২৪-২৫ নভেম্বর সেখানে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছিল প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কয়েকটি কোম্পানির সমন্বয়ে গড়ে তোলা মুক্তিবাহিনীর একটি বড় দল। এই বাহিনীভুক্ত ডেলটা কোম্পানির ১২ নম্বর প্লাটুনের কমান্ডার ছিলেন ওয়াকার হাসান।

কানাইঘাটের চারপাশে বেশ কয়েকটি গ্রাম—গৌরীপুর, বড় চাতাল, ডালিয়ার চর প্রভৃতি। উত্তর-পূর্বে আনন্দ বিল নামে ছিল একটি ছোট বিল। মাঝ দিয়ে বহমান সুরমা নদী। ২৪-২৫ নভেম্বরেও পাকিস্তানি সেনারা গৌরীপুরে অতর্কিতে মুক্তিবাহিনীর আলফা কোম্পানির ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল। ফলে সেখানে সংঘটিত হয়েছিল প্রচণ্ড যুদ্ধ।

ওয়াকার হাসান ১৯৭১ সালে রাজশাহী প্রকৌশল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঢাকা থেকে পালিয়ে ভারতে যান। সেখানে একটি শিবিরে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় তিনি প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁকে জেড ফোর্সের প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি বৃহত্তর সিলেটের শ্রীমঙ্গল, পাত্রখোলা, হোসনাবাদ, চারগ্রাম, এমসি কলেজসহ কয়েকটি স্থানে যুদ্ধ করেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান