বিজ্ঞাপন
default-image

‘সহযোদ্ধা আবদুল লতিফ রাতভর যুদ্ধ করে ক্লান্ত। আশ্রয় নিয়েছিলেন একটি কবরে। একসময় সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েন। ভোরে অস্ত্রসহ ধরা পড়েন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। লতিফকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সেই দৃশ্য দেখছে সাধারণ মানুষ। আর আমি অস্ত্র লুকিয়ে রেখে মিশে আছি জনতার কাতারে। লতিফ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। পাল্টা আক্রমণ করে যে তাকে উদ্ধার করব, সে উপায়ও নেই। সেদিন তাকে রক্ষা করতে পারিনি। তার সেই ভয়ার্ত মুখ, বাঁচার করুণ আকুতি এখনো আমার মনে পড়ে।’ বললেন মুক্তিযোদ্ধা এম এ হালিম (৬০)। ১৪ ডিসেম্বর এ ঘটনা ঘটেছিল ছাতকের গোবিন্দগঞ্জ এলাকায়। সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে পাকিস্তানি সেনাদের ঘিরে ফেলেন। সন্ধ্যায় শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ, চলে সারা রাত। দোয়ারাবাজারের বাঁশতলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। ভোরে অস্ত্রসহ পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন তিনি।

এম এ হালিম শেলা সাব-সেক্টরের একটি কোম্পানির প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন। তাঁরা ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতিতে যুদ্ধ করতেন। পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতেন। এরপর পাকিস্তানি সেনারা একনাগাড়ে গুলি চালাত। তাদের গুলি থামলে তাঁরা আবার গুলি করতেন। তিনি দোয়ারাবাজারের টেংরাটিলা, নরসিংহপুর, আলীপুর, হাছনবাহার, বালিউড়া, ছাতকের হাদাটিলা ও দুরবিনটিলা এলাকায় যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ১৩ অক্টোবর তাঁর নেতৃত্বে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের জাউয়া সেতু উড়িয়ে দেওয়া হয়। এই অপারেশনের এক দিন আগে দুই মুক্তিযোদ্ধাকে মাদ্রাসার ছাত্র সাজিয়ে তাঁদের সঙ্গে কুলি হিসেবে জাউয়া সেতু রেকি করতে যান তিনি। সেতুর ওপর গিয়েই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁরা তর্কাতর্কি শুরু করেন। এ সময় কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা তাঁদের কাছে এসে কী হয়েছে, জানতে চায়। ছাত্রবেশী দুই মুক্তিযোদ্ধা তাঁকে দেখিয়ে বলেন, ‘এই কুলির বাচ্চা বলেছিল মালপত্র নিয়ে মাদ্রাসা পর্যন্ত যাবে। এখন মাঝপথে এসে বলছে, যাবে না।’ এর ফাঁকে তিনি পুরো সেতু রেকি করে ফেলেন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে ধমক দিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে পাঠিয়ে দেয়। পরদিন সেতুটি তাঁরা ধ্বংস করেন। এই সফল অপারেশনের পর সেক্টর কমান্ডার তাঁদের পুরস্কৃত করেন। পরে তাঁকে ছাতক-গোবিন্দগঞ্জ সড়কের আরেকটি সেতু উড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এম এ হালিম ১৯৭১ সালে সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এলাকার কয়েকজন ছাত্র-যুবককে নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ভারতের রেঙ্গুয়া বাজারে গিয়ে তাঁরা নাম লেখান মুক্তিবাহিনীতে। ইকো-১ ট্রেনিং সেন্টারে এক মাসের ট্রেনিং শেষে তাঁদের পাঠানো হয় ৫ নম্বর সেক্টরের বালাট সাব-সেক্টরে। সেখানে এক যুদ্ধে আহত হন তিনি। বালাট এলাকা সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণা ছিল না। পরে তাঁদের নিজেদের এলাকায় পাঠানো হয়। তাঁদের মোট ৭৩ জন শেলা সাব-সেক্টরে এসে যোগ দেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান