মুক্তিযুদ্ধকালে রাজধানী ঢাকায় অচলাবস্থা সৃষ্টির জন্য ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলাবাহিনী গঠন করা হয়। এর মধ্যে ক্র্যাক প্লাটুন ছিল অন্যতম। পাকিস্তানি সেনাদের সর্বক্ষণ ভীতসন্ত্রস্ত ও বিশ্রামহীন রাখা এবং দেশের অভ্যন্তরে সংগ্রামী জনতার মনোভাব দৃঢ় রাখার জন্যই এ বাহিনীর সৃষ্টি। এ বাহিনী গঠনে যিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তিনি এ টি এম হায়দার। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে ক্র্যাক প্লাটুন গড়ে ওঠে। বেশির ভাগ গেরিলাকে তিনি নিজেই প্রশিক্ষণ দেন। তাঁর বিচক্ষণতায় ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা তখন চোরাগোপ্তা আক্রমণের মাধ্যমে ঢাকার বিভিন্ন অফিস-আদালতসহ প্রশাসনিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটান। গেরিলারা যোগাযোগ ও বিদ্যুত্-ব্যবস্থা অচল করার পাশাপাশি ঢাকার আশপাশে গেরিলাযুদ্ধও চালান। ক্র্যাক প্লাটুন গঠন ও পরিচালনায় এ টি এম হায়দার যে দেশপ্রেম ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন, তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
এ টি এম হায়দার ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্কেশাল সার্ভিস গ্রুপের (এসএসজি) কর্মকর্তা, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমান্ডো ও প্যারাট্রুপার। ১৯৭০ সালের শেষ দিক থেকে তিনি কর্মরত ছিলেন কুমিল্লা সেনানিবাসের ৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়নে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। ২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাদের চলাচল বিঘ্নিত করার লক্ষ্যে এ টি এম হায়দার নিজেই দেশের অভ্যন্তরে সেতু ধ্বংসসহ বেশ কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন। পরে ভারতের মেলাঘরে গণযোদ্ধাদের তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে অস্ত্র, বিস্ফোরক ও গেরিলাযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেন। তাঁদের তিনিই তত্ত্বাবধান করতেন। তাঁর প্রশিক্ষিত গেরিলারা চীন, কিউবা ও ভিয়েতনামের গেরিলাদের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলেন না। ২ নম্বর সেক্টরের গণযুদ্ধে এ টি এম হায়দার আজও একজন প্রবাদপুরুষ। তিনি ছিলেন অধিনায়ক খালেদ মোশাররফের একজন যোগ্য সহযোগী। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে খালেদ মোশাররফ আহত হলে তিনি অধিনায়ক নিযুক্ত হন। তিনি সাহস ও বীরত্ব দিয়ে এ দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গে পালন করেন।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ চূড়ান্ত হলে মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের জিওসি-ইন-সি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিত্ সিং অরোরা, বাংলাদেশ বাহিনীর উপপ্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকারের সঙ্গে এ টি এম হায়দারও ঐতিহাসিক রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে উপস্থিত হন। ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে এ কে খন্দকার ও কে এম সফিউল্লাহর সঙ্গে তিনিও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
উল্লেখ্য, বীর প্রতীক ডা. সিতারা বেগম তাঁর বোন।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান