বিজ্ঞাপন
default-image

কুমিল্লা জেলার সদর উপজেলার অন্তর্গত কংসতলা। ১৯৭১ সালে সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি ঘাঁটি। এখানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা ওই এলাকায় নিয়মিত টহল দিত। এ কারণে কুমিল্লার দক্ষিণে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যক্রম আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে সীমিত হয়ে পড়ে।

এই এলাকা ছিল মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের নির্ভয়পুর সাবসেক্টরের অধীন। সেপ্টেম্বরের শেষে এই সাবসেক্টরের ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল কংসতলায় আকস্মিক আক্রমণ চালায়। এই দলে ছিলেন আলী আশরাফ। তাঁরা ৩০ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত একটায় ওই ঘাঁটিতে ঢুকে আক্রমণ চালান। তিন ঘণ্টার যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা চরম ক্ষতির মুখে পড়ে। ১৬ জন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয় এবং আটজন আহত হয়।

এই যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পরে তারা সেখানকার অবস্থান পরিত্যাগ করে কুমিল্লায় চলে যেতে বাধ্য হয়। সেদিন আলী আশরাফ ও তাঁর কয়েকজন সহযোদ্ধা যথেষ্ট সাহস ও শৌর্যের পরিচয় দেন। মূলত তাঁদের বীরত্বেই পাকিস্তানি সেনাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

মিয়াবাজারে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি ঘাঁটি। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি আলী আশরাফরা সেখানে আক্রমণ করেন। এতে পাকিস্তানি সেনাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এরপর ১০ নভেম্বর পিপুলিয়া-হাজতখোলায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি টহলদলকে তাঁরা অ্যামবুশ করেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই টহলদলটি ছিল বেশ বড়। তারা পাল্টা আক্রমণ করে। মুখোমুখি যুদ্ধের একপর্যায়ে তাঁদের দলনেতা লেফটেন্যান্ট মেহবুবুর রহমান (বীর উত্তম) পাকিস্তানি সেনাদের ঘেরাওয়ে পড়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পড়েন।

দলনেতার জীবন বাঁচাতে আলী আশরাফ ও তাঁর কয়েকজন সহযোদ্ধা তখন নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর। তাঁদের ঝটিকা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এই সুযোগে লেফটেন্যান্ট মেহবুবুর রহমান নিরাপদ স্থানে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু আলী আশরাফ পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা গুলিবর্ষণে গুরুতর আহত হন। সঙ্গে সঙ্গে নিভে যায় তাঁর জীবনপ্রদীপ।

যুদ্ধ শেষে আলী আশরাফের মরদেহ তাঁর সহযোদ্ধারা উদ্ধার করেন। পরে তাঁকে সমাহিত করেন বসন্তপুরে। তাঁর সমাধি সেখানে সংরক্ষিত।

আলী আশরাফ চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ তাঁর ইউনিট মোতায়েন ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি গাড়িচালক ছিলেন। ২৭ মার্চ মেজর শাফায়াত জামিলের (বীর বিক্রম, পরে কর্নেল) নেতৃত্বে যুদ্ধে যোগ দেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ২ নম্বর সেক্টরের নির্ভয়পুর সাবসেক্টরে তিনি যুদ্ধ করেন। তাঁর আরেক ভাই সিরাজুল ইসলামও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ইনফরমার ছিলেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান