বিজ্ঞাপন
default-image

কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারীর কোদালকাটিতে ছিল মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান। কয়েকটি চরের সমন্বয়ে কোদালকাটি। প্রতিটি চরেই ছিল মুক্তিবাহিনী। একটি চরে ছিলেন আবদুস সাত্তার। তাঁর দলের নেতৃত্বে ছিলেন সুবেদার ওহাব। ৪ আগস্ট পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে কোদালকাটির একাংশ দখল করে দেয়। তাদের লক্ষ্য ছিল ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে রৌমারী থানা সদরে পতাকা উত্তোলন করা। ১৩ আগস্ট বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা গানবোট, লঞ্চ ও বার্জে করে সোনাভরী নদীর মোহনা হয়ে রৌমারীর রাজিবপুরের দিকে অগ্রসর হয়। তখন নটারকান্দি গ্রামে অবস্থানরত আবদুস সাত্তারের দল এবং অন্যান্য চরে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের দল পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিহত করার জন্য একযোগে আক্রমণ করে। সারা দিন ব্যাপক গোলাগুলি হয়। বিকেলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পিছু হটে তাদের কোদালকাটি ঘাঁটিতে অবস্থান নেয়।

রাতে আবদুস সাত্তার ও সহযোদ্ধারা অবস্থান নেন হাজীর চরের গোয়ালঘর এলাকায়। কাছেই ছিল পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান। সেখানে তাদের গানবোট, লঞ্চ ও বার্জ নোঙর করা ছিল। দলনেতা সুবেদার ওহাবের নির্দেশে আবদুস সাত্তার সহযোদ্ধা তরিকুলকে সঙ্গে নিয়ে গভীর রাতে নদী সাঁতরে একটি গানবোটের কাছে গিয়ে তাতে মাইন লাগান। কিছুক্ষণ পর বিকট শব্দে মাইন বিস্ফোরিত হয়ে ওই গানবোট ধ্বংস হয়। এটা ছিল আবদুস সাত্তারের প্রথম সফল অপারেশন। তাঁর এই দুঃসাহসিক অভিযানের ফলে রৌমারীতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের পতাকা তুলতে পারেনি।

আবদুস সাত্তার ১৯৭১ সালে রাজশাহী ইপিআর ক্যাম্পে কর্মরত ছিলেন। ২৭ মার্চ তিনি অন্যান্য ইপিআর সদস্যসহ বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে তিনি ভারতে যান। সেখানে অবস্থানকালে তাঁদের বেশির ভাগ সদস্যকে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি ছিলেন আলফা কোম্পানিতে। পরে জেড ব্রিগেডের অধীনে সিলেটের ছাতক ও গোয়াইনঘাটে যুদ্ধ করেন। ১৩ থেকে ১৭ অক্টোবর ছাতকের পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করে। কয়েক দিন সেখানে যুদ্ধ চলে। ১৪ ও ১৬ অক্টোবর সেখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এই অপারেশনে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তুলনামূলকভাবে পাকিস্তানি সেনাদের ক্ষতিই ছিল বেশি। মুক্তিবাহিনীর আরআর গানের গোলার আঘাতে পাকিস্তানি সেনাদের বেশ কয়েকটি বাংকার ধ্বংস হয়। দুটি বাংকার ধ্বংসে আবদুস সাত্তার নেতৃত্ব দেন।

২৩ অক্টোবর আবদুস সাত্তার ও দলের সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গোয়াইনঘাট অবস্থানে আক্রমণের জন্য সেখানে সমবেত হন। তাঁদের অবস্থান ছিল গোয়াইন বাজারের দক্ষিণে নদীর তীরে। ২৪ অক্টোবর, তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা হবে। তাঁরা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এ সময় পাকিস্তানি সেনারাই তাঁদের আকস্মিক আক্রমণ করে। এই আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর বেশ কজন শহীদ হন। প্রাথমিক ধকল কাটিয়ে মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ করেন। দিনভর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলে। এ যুদ্ধে সাত্তারের পায়ে গুলি লাগে। পায়ের শিরা ছিঁড়ে গুলি বেরিয়ে যায়। এর পরও যুদ্ধ করতে থাকেন তিনি। একপর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে পড়লে সহযোদ্ধারা তাঁকে বাঁশতলায় নিয়ে যান। সেখানে প্রাথমিক চিকিত্সা দিয়ে তাঁকে ভারতের শিলং হাসপাতালে পাঠানো হয়।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান