বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল যশোর জেলার কালীগঞ্জে। এখানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা স্থানীয় মানুষের ওপর ব্যাপক অত্যাচার চালাত। মুক্তিবাহিনীর আবদুল মান্নান ও তাঁর দল ওই ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা করে। কিন্তু ক্যাম্প সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না তাঁদের। শত্রুর শক্তি সম্পর্কে জেনে আক্রমণ পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। এক দিন আবদুল মান্নান নিজেই গুপ্তচর হয়ে ক্যাম্পে ঢোকার সিদ্ধান্ত নেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে চাকরির সুবাদে তিনি জানতেন, পাকিস্তানি সেনারা চিংড়ি মাছ পছন্দ করে। বাজার থেকে একটি সাজিসহ কিছু চিংড়ি মাছ কিনে আনেন তিনি। ওই সাজি নিয়ে মাছ বিক্রেতা হিসেবে ওদের ক্যাম্পে ঢুকে পড়েন। ময়লা লুঙ্গি, সাজিতে মাছ দেখে সন্দেহ না করলেও বাঙালি হওয়ায় তাঁকে অনেক গালমন্দ করে পাকিস্তানি সেনারা। মারধরও করে। মান্নান তাদের বলেন, ‘তিন দিন ধরে না খেয়ে আছি। পেটের দায়ে এসেছি।’ এক পাকিস্তানি সেনা তাঁকে খাবার এনে দেয়। খেয়ে সব তথ্য নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি।

শত্রুদের অবস্থা ও গোলাবারুদের অবস্থান জেনে সেদিন রাতেই আবদুল মান্নান ও তাঁর সহযোদ্ধারা আক্রমণ চালান পাকিস্তানি সেনাদের ওই ক্যাম্পে। হঠাৎ আক্রমণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা। কিছুক্ষণ গুলি-পাল্টা গুলি চলে, তাতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। একপর্যায়ে তাদের আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেন আবদুল মান্নান। উপায় না দেখে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন আবদুল মান্নান। কর্মরত ছিলেন পাকিস্তানে। ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে পাকিস্তান থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসেন। ছুটি শেষ হলে ঢাকা সেনানিবাসের ট্রানজিট ক্যাম্পে যোগ দেন পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে আবদুল মান্নান ঢাকা থেকে পালিয়ে বরিশালে চলে আসেন। বরিশালে স্থানীয় প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে শামিল হন। পরে মুক্তিবাহিনীর ৯ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন ওমরের সরাসরি তত্ত্বাবধানে যুদ্ধ করেন তিনি। বাবুগঞ্জের ঝুনাহার এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সরাসরি এক যুদ্ধে অংশ নেন আবদুল মান্নান। তাঁর গুলিতে এক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ছোড়া একটি গুলি তাঁর পায়ে লাগে।

বাবুগঞ্জ উপজেলার শরিকল ইউনিয়নের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী রাজাকার খাদেম মীরা নির্বিচারে মানুষ মারার জন্য নিজের বাড়িতে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের ঘাঁটি গড়ে তোলে। এক দিন খাদেম মীরার বাড়ির চারদিক ঘিরে ফেলেন আবদুল মান্নান ও তাঁর সহযোদ্ধারা। আবদুল মান্নান খেজুরগাছ বেয়ে ওই বাড়িতে ঢুকে প্রথম আক্রমণ চালান। সেখানে ১৮ জন রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অন্যরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নেন তিনি।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান