বিজ্ঞাপন
default-image

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আবদুল ওহাব সম্পর্কে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত ছিল। তিনি ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ত্রাস। একের পর এক অ্যামবুশ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে ফিরে যেতেন বিজয়ীর বেশে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে আটক বা হত্যা করার জন্য অনেকবার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়। তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য তারা দুবার ৫০ হাজার টাকার পুরস্কারও ঘোষণা করে। অসংখ্য স্থানে অ্যামবুশ করেন আবদুল ওহাব। এর মধ্যে কালতাদীঘির পাড়, শালগড়, লোত্তামুড়া, সালদা নদী, মন্দভাগ, ঝিকুরা, গোবিন্দপুর, মীরপুর-মাধবপুর এবং চান্দলার অ্যামবুশ ও অপারেশন উল্লেখযোগ্য।

১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিলের ঘটনা। সে সময় তিনি তাঁর প্লাটুন (৭ নম্বর) নিয়ে দেবীপুরে ছিলেন। খবর পেলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৭০-৭২ জনের একটি দল সালদা নদীর দিকে আসছে। খবর পেয়ে তিনি কোম্পানি (চার্লি) কমান্ডার আবদুল গাফফারের কাছে অভিপ্রায় জানালেন পাকিস্তানি সেনাদের অ্যামবুশ করার। তিনি সম্মতি দিলেন। ওহাব তৈরিই ছিলেন। রওনা হয়ে কালতাদীঘির পাড়ে গিয়ে জানতে পারলেন, পাকিস্তানি সেনারা ততক্ষণে সালদা নদীর কাছে পৌঁছে গেছে। তিনি তাত্ক্ষণিকভাবে সেখানেই অ্যামবুশ করলেন। কারণ, পাকিস্তানি সেনাদের ওই জায়গা দিয়েই কসবা যেতে হবে।

ওহাব একটি গাছে উঠে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলেন। একটু পর দূরে দেখতে পেলেন, পাকিস্তানি সেনারা ফিরে আসছে। তাদের গাইড হিসেবে আছে চার-পাঁচজন বাঙালি। তারা সামনে। পেছনে একজন অফিসারের নেতৃত্বে সেনারা দুই সারিতে দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে আসছে। গাছ থেকে নেমে সহযোদ্ধাদের কর্তব্য ঠিক করে দিয়ে বললেন, তিনি গুলি ছোড়ার আগে কেউ যেন গুলি না ছোড়েন। তারপর তাঁরা অপেক্ষা করতে থাকেন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের অস্ত্রের গুলির আওতায় আসামাত্র প্রথম গর্জে উঠল আবদুল ওহাবের এলএমজি। সঙ্গে সঙ্গে সহযোদ্ধা ৩৫ জনের অস্ত্র থেকে একযোগে গুলি শুরু হলো।

পাকিস্তানি সেনাদের সেখানে আত্মরক্ষার তেমন জায়গা ছিল না। একমাত্র স্থান ছিল সড়কসংলগ্ন খাল। আক্রমণে লুটিয়ে পড়ে অসংখ্য পাকিস্তানি সেনা। আকস্মিক আক্রমণে দিশেহারা পাকিস্তানি সেনাদের কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ে খালে, কেউ পজিশন নিয়ে গুলি চালাতে শুরু করে। আচমকা এই আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এক ঘণ্টা পাল্টাপাল্টি গুলির পর মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করেন। পরে ওহাব খবর পান, ১৮ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং নয়জন আহত হয়েছে।

ঝিকুরা অ্যামবুশে (১০ জুলাই) পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল, দুজন মেজর, তিনজন ক্যাপ্টেন, একজন সুবেদার মেজর, একজন সেনা, একজন সিভিল পোশাকের ইঞ্জিনিয়ার, একজন ব্যবসায়ীসহ ১২ জন নিহত হয়। তারা একটি স্পিডবোটে করে সালদা নদী দিয়ে যাচ্ছিল। ওহাবের অ্যামবুশে স্পিডবোট সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস হয়। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে কুখ্যাত পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন বোখারিও ছিল। বোখারি ১৯৭১ সালে কুমিল্লায় অসংখ্য নিরস্ত্র বাঙালিকে গুলি করে হত্যা করে। মেয়েদের ওপর অত্যাচার চালায়।

আবদুল ওহাব পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁর ইউনিটের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান