বিজ্ঞাপন
default-image

সকালে খুলনার জলসীমায় নির্বিঘ্নেই পৌঁছে তিনটি গানবোট। এর দুটি ছিল মুক্তিবাহিনীর। অপরটি ভারতীয় নৌবাহিনীর। মুক্তিবাহিনীর একটি গানবোটে ছিলেন আবদুল আউয়াল সরকার। গানবোটগুলো পথে কোথাও বাধা পায়নি। সেগুলো দ্রুত এগিয়ে যায়।

১০ ডিসেম্বর রণতরিগুলো যখন খুলনার পাকিস্তানি নৌঘাঁটির কাছাকাছি, তখন আকাশে দেখা যায় ওই তিন জঙ্গি বিমান। পলাশ গানবোটে ছিলেন আবদুল আউয়াল সরকার। শত্রুবিমান মনে করে পদ্মা ও পলাশের নৌ-মুক্তিযোদ্ধারা বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র দিয়ে গোলাগুলি করতে উদ্যত হন। কিন্তু ভারতীয় নৌবাহিনীর প্যানভেল গানবোট থেকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে জানানো হয় ওগুলো ভারতীয় বিমান।

এরপর বিমানগুলো কিছুটা নিচে নেমে দক্ষিণ-পশ্চিমে সাগরের দিকে চলে যায়। ১০-১১ মিনিট পর হঠাত্ ঘুরে এসে বোমাবর্ষণ করে পদ্মার ওপর। পরক্ষণেই পলাশে। যদিও গানবোটগুলো মুক্তি না মিত্রবাহিনীর তা শনাক্তের জন্য ছাদে ১৫ ফুট লম্বা এবং ১০ ফুট চওড়া হলুদ কাপড় বিছানো ছিল। তার পরও এই দুর্ঘটনা ঘটে।

ভারতীয় নৌবাহিনীর প্যানভেল গানবোটে বিমানগুলো বোমাবর্ষণ করেনি। সেটি তখন বেশ এগিয়ে ছিল। বোমার আঘাতে মুক্তিবাহিনীর গানবোটে আগুন ধরে যায়। দুই গানবোটে আবদুল আউয়াল সরকারসহ ৫৬ জন নৌযোদ্ধা ছিলেন। বিপদ আন্দাজ করে কেউ কেউ আগেই পানিতে ঝাঁপ দেন। কিন্তু আউয়ালসহ যাঁরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গানবোটে ছিলেন, তাঁদের কয়েকজন শহীদ এবং বাকি প্রায় সবাই আহত হন।

ঘটনাচক্রে আবদুল আউয়াল সরকার তেমন আহত হননি। তিনি গুরুতর আহত দুই-তিনজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে পানিতে ঝাঁপ দেন। আহত অন্য নৌ-মুক্তিযোদ্ধারাও যে যাঁর মতো পানিতে ঝাঁপ দেন। অনেকে সাঁতার কেটে নদীর পাড়ে ওঠেন। নদীতীরে ছিল পাকিস্তানি সেনা বা তাদের সহযোগী রাজাকার। আবদুল আউয়াল সরকার, রুহুল আমিনসহ (বীরশ্রেষ্ঠ) কয়েকজনকে রাজাকাররা আটক করে। রুহুল আমিনকে রাজাকাররা তখনই হত্যা এবং বাকিদের নির্যাতনের পর পাকিস্তানিদের কাছে হস্তান্তর করে। পাকিস্তানিরা তাঁকেসহ অন্যদের জেলে পাঠায়। স্বাধীনতার পর তিনি মুক্তি পান।

আবদুল আউয়াল সরকার পাকিস্তানি নৌবাহিনীতে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন পাকিস্তানের (তখন পশ্চিম পাকিস্তানি) করাচিতে। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ছুটিতে বাড়িতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাতে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান।

প্রথমে তিনি ২ নম্বর সেক্টরে স্থল মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয়ভাবে নানা সহায়তা করেন। এ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রেকি করতে এসে তিনি আটক হন। কৌশলে মুক্তি পেয়ে আবার ভারতে যান। পরে তিনি মুক্তিবাহিনীর নৌদলে অন্তর্ভুক্ত হন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান