বিজ্ঞাপন
default-image

আবদুর রউফ ১৯৭১ সালে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে মায়ের কাছে অনুমতি চাইলেন। কিন্তু মা সায় দিলেন না। কয়েক দিন পর আরও আটজনকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে রওনা হলেন ভারতের উদ্দেশে। তিন দিন হেঁটে পৌঁছালেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তসংলগ্ন এক ক্যাম্পে। অনেক দিন অপেক্ষা করার পর শুরু হলো প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ চলাকালে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় প্রথম বাংলাদেশ অফিসার্স ওয়ার কোর্সে। তিন মাসের প্রশিক্ষণ শেষে তিনি যুদ্ধ করেন ৫ নম্বর সেক্টরের অন্তর্গত শেলা সাব-সেক্টরে। তাঁকে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

আবদুর রউফ শেলা সাব-সেক্টরে যোগ দেন ১০ অক্টোবর। এই সাব-সেক্টরের অধীন এলাকায় বেশ কয়েকটি বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এর মধ্যে ছাতক যুদ্ধ (১৩-১৭ অক্টোবর) ও টেংরাটিলা আক্রমণের (৩০ নভেম্বর) ঘটনা উল্লেখযোগ্য। সীমান্তবর্তী হওয়ায় মুক্তিবাহিনীর পক্ষে এই এলাকায় অপারেশন পরিচালনা করা কিছুটা সহজ ছিল। সাব-সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশে নভেম্বরে তিনি একদল মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের একটি সেতু ধ্বংস করেন।

নির্ধারিত দিন তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় ১৪০ জনের একটি দল ভারত থেকে রওনা হয় নির্দিষ্ট স্থানের উদ্দেশে। সেতুর কাছাকাছি পৌঁছে রেকি করতে গিয়ে তাঁরা দেখতে পান, সেতুতে পাহারায় আছে একদল পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার। রাত আনুমানিক তিনটায় তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালান। তারাও পাল্টা আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা আবদুর রউফের নেতৃত্বে অত্যন্ত সাহস ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকেন। আড়াই ঘণ্টা যুদ্ধের পর তাঁরা সেতুর দখল নেন। পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা হতাহত ব্যক্তিদের নিয়ে টেংরাটিলার দিকে পালিয়ে যায়। এরপর তাঁরা রেল ও সড়কসেতুতে দ্রুত বিস্ফোরক সংযুক্ত করে তা ধ্বংস করেন। এই অপারেশনে আবদুর রউফ যথেষ্ট রণকৌশল ও সাহসের পরিচয় দেন।

এর দিন কয়েক পরই সংঘটিত হয় টেংরাটিলা যুদ্ধ। সিদ্ধান্ত অনুসারে ২৯ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর চারটি কোম্পানি ভারত থেকে রওনা হয়ে ৩০ নভেম্বর টেংরাটিলার নির্ধারিত জায়গায় অবস্থান নেয়। নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটি দল মূল আক্রমণকারী দল হিসেবে আক্রমণ করে টেংরাটিলার পাকিস্তানি অবস্থানে। আবদুর রউফ এ সময় তাঁর দল নিয়ে ফ্ল্যাস্কগার্ড হিসেবে যুদ্ধে অংশ নেন। কয়েক দিন এখানে যুদ্ধ চলে। টেংরাটিলায় পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থান এতই সুদৃঢ় ছিল যে মুক্তিযোদ্ধারা বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেও কিছুতেই সামনে অগ্রসর হতে পারছিলেন না। এ অবস্থায় তাঁরা তিন দিক থেকে পাকিস্তানি সেনাদের অবরোধ করেন। ৫ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি সেনারা টেংরাটিলা থেকে পালিয়ে যায়।

আবদুর রউফ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে অবসর নেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান