বিজ্ঞাপন
default-image

খালাতো বোন জুঁইয়ের সঙ্গে প্রেম, দুজনে বিয়ে করবেন কিন্তু নানা জটিলতা, বিশেষত সেনা চাকরির কারণে আফতাবুল কাদের সময় ও সুযোগ করে উঠতে পারছিলেন না। চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে। কর্মরত ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের হায়দরাবাদে ফিল্ড রেজিমেন্টে। সুযোগ এল ১৯৭১ সালে। তিনি ছুটি নিয়ে ঢাকায় আসেন। ২০ মার্চ চট্টগ্রামে রেজিস্ট্রি বিয়ে হয় তাঁদের। সংসার শুরু করবেন তাঁরা, এল ২৫ মার্চের কালরাত। সেদিন তিনি ঢাকার ফরিদাবাদের বাসায়।

একদিকে নতুন জীবনের হাতছানি, অন্যদিকে দেশের ডাক। আফতাবুল কাদের বেছে নিলেন দেশকেই। ঢাকার বাসায় মা-বাবাসহ তিন দিন অবরুদ্ধ ছিলেন। ২৮ মার্চ বেরিয়ে পড়লেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে। প্রথমে যান চট্টগ্রামে। সেখান থেকে রামগড়ে। দেখা হয় জিয়াউর রহমানের (বীর উত্তম) সঙ্গে। আফতাবুলকে তিনি মহালছড়ি এলাকায় অবস্থানরত প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিতে বলেন। এরপর তিনি সেখানে যান।

২৭ এপ্রিল সকাল থেকে মহালছড়ির চারদিকে থমথমে অবস্থা। প্রতিরোধযোদ্ধারা খবর পেয়েছেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডো ব্যাটালিয়নের একটি কোম্কানি তাঁদের অবস্থানের দিকে এগিয়ে আসছে। প্রতিরোধযোদ্ধাদের একটি দলের নেতৃত্বে আছেন ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একদল সেনা তাঁর অধীনে। সকাল নয়টার দিকে ঝোড়োগতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডো দল তাঁদের অবস্থানে আক্রমণ শুরু করে। এই আক্রমণ এতটা শক্তিশালী হবে তাঁরা কল্পনাও করেননি। দেখা গেল, পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে বিদ্রোহী মিজোরাও আছে। ১৯৭১ সালে মিজোরা পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষাবলম্বন করে। তারাও সংখ্যায় কয়েক শ। এদিকে এক কোম্কানি পাকিস্তানি কমান্ডো আগেই ছদ্মবেশে মিজোদের সঙ্গে মিশে ছিল। এসব প্রতিরোধযোদ্ধাদের ধারণার বাইরে ছিল।

দুই কোম্পানি পাকিস্তানি কমান্ডো ও শত শত প্রশিক্ষিত বিদ্রোহী মিজো প্রতিরোধযোদ্ধাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। প্রতিরোধযোদ্ধারা অসীম সাহসের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডো ও মিজোদের মোকাবিলা করতে থাকেন। প্রায় তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পর তাঁদের গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে আসে। এ অবস্থায় তাঁরা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। তখন তাঁরা কৌশলগত কারণে পাকিস্তানি ও মিজোদের বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় প্রতিরোধযোদ্ধাদের সবচেয়ে কার্যকর মেশিনগান অবস্থান থেকে কাভারিং ফায়ার দেওয়া হচ্ছিল, যাতে তাঁরা নিরাপদে পশ্চাদপসরণ করতে পারেন। হঠাত্ সেই মেশিনগান অকেজো হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি সেনারা তখন তাঁদের দেড়-দুই শ মিটারের মধ্যে চলে এসেছে।

নতুন এই বিপর্যয়ে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের এককভাবে সাহসী ও অনন্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি গোলাগুলির মধ্যেই দৌড়ে গুরুত্বপূর্ণ উঁচু স্থানে অবস্থান নেন। হাতে একটা এলএমজি। তিনি এলএমজি দিয়ে একনাগাড়ে কাভারিং গুলি করতে থাকেন। তাঁর এই দুঃসাহসিক ভূমিকা ও এলএমজির কার্যকর ফায়ারের কারণে প্রতিরোধযোদ্ধাদের বেশির ভাগই নিরাপদে পশ্চাদপসরণ করতে সক্ষম হন। কিন্তু চরম মূল্য দিতে হলো আফতাবুলকে। তিন-চারটি গুলি এসে লাগে তাঁর বুকে। গুলি তাঁর হৃদপিণ্ড ভেদ করে পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। এর পরও তিনি বেঁচে ছিলেন। অস্ত্র থেকে হাত সরাননি তিনি, মুমূর্ষু অবস্থাতেও গুলি করার চেষ্টা করেন।

শওকত ও ফারুক নামের দুজন স্বেচ্ছাসেবী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আফতাবুল কাদেরকে উঁচু স্থান থেকে নামিয়ে গোলাগুলির মধ্যেই একটি জিপে করে রওনা হন ফিল্ড হাসপাতালে। পথে তিনি শহীদ হন। রামগড় শহরেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। সেদিন তাঁর বীরত্বের জন্য প্রায় ৫০০ প্রতিরোধযোদ্ধা ও স্বেচ্ছাসেবী বেঁচে যান।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান