বিজ্ঞাপন
default-image

আফজাল মিয়া ও তাঁর সহযোদ্ধাদের গানবোট দুপুরের মধ্যেই নির্বিঘ্নে পৌঁছে গেল রূপসা নদীতে, খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছাকাছি। ওই গানবোটের সঙ্গে আছে আরও দুটি জাহাজ। তিনটির মধ্যে দুটি মুক্তিবাহিনীর, অপরটি ভারতীয় নৌবাহিনীর। মুক্তিবাহিনীর জাহাজের নাম ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’, ভারতীয় জাহাজের নাম ‘আইএনএস প্যানভেল’। মুক্তিযোদ্ধারা জাহাজে করে যাচ্ছেন খুলনায় পাকিস্তানি নৌঘাঁটি দখলের জন্য। এই অপারেশনের সাংকেতিক নাম ‘অপারেশন হটপ্যান্টস’। বহরের সামনে প্যানভেল, মাঝে কিছুটা দূরত্বে পদ্মা, পেছনে পলাশ। কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই এগিয়ে যাচ্ছে জাহাজগুলো। আফজাল মিয়া পদ্মা জাহাজের আর্টিফিশার। সেদিন তিনি ইঞ্জিনরুমে নিজের কাজে ব্যস্ত। এ সময় গোটা জাহাজ কেঁপে উঠে ইঞ্জিনরুমে আগুন ধরে গেল। তিনি ছিটকে পড়লেন। যখন হুঁশ হলো তখন কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না। ক্ষতবিক্ষত আফজাল মিয়া অনেক কষ্টে ইঞ্জিনরুম থেকে বেরিয়ে এলেন ডেকে। সেখানে এক করুণ দৃশ্য—চিত্কার, চেঁচামেচি, দৌড়াদৌড়ি। নিহত সহযোদ্ধাদের লাশের পর লাশ পড়ে আছে। আহত সহযোদ্ধারা কাতরাচ্ছেন। অক্ষত সহযোদ্ধারা ছোটাছুটি করছেন পানিতে লাফিয়ে পড়ার জন্য। যে যেভাবে পারছেন নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন জীবন বাঁচাতে। আহত আফজাল মিয়ার মুখমণ্ডল ও হাত-পা রক্তাক্ত। এরপর তিনি কীভাবে কখন নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, নিজেও জানেন না। পরনে লাইফ জ্যাকেট থাকায় ভাসতে থাকলেন। তখনো ঠিকমতো দেখতে পারছেন না। অনেকক্ষণ পর দেখেন, তিনি নদীর তীরে। সেখানে এক রাজাকার তাঁকে আটক করে। এর পরের ঘটনা—সে আরেক কাহিনি।

এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বরের। ঘটেছিল খুলনার রূপসা নদীতে। সেদিন ভারতীয় জঙ্গি বিমান ভুলক্রমে মুক্তিবাহিনীর এ দুই জাহাজে বোমাবর্ষণ করে। এতে জাহাজ দুটি বিধ্বস্ত হওয়ার পাশাপাশি মুক্তিবাহিনীর নৌ উইংয়ের অনেকে শহীদ ও আহত হন। এ বিমান হামলায় আফজাল মিয়াসহ কয়েকজন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। সেদিন দুপুরে তিনটি জঙ্গি বিমান তাঁদের জাহাজের ওপর দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে সাগরের দিকে উড়ে যায়। জাহাজের নৌসেনারা বিমানগুলোকে পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান মনে করে সম্ভাব্য হামলা মোকাবিলায় ক্যাপ্টেনের কাছে অনুমতি চাইলেও তিনি সে অনুমতি দেননি। ক্যাপ্টেন ছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, ঘটনার ওখানেই শেষ। কিন্তু তাঁর সেই ধারণা ছিল ভুল। পরে বিমানগুলো আবার পেছন দিক থেকে জাহাজ লক্ষ্য করে এগিয়ে আসে। খুব নিচু দিয়ে উড়ে এসে কোনো রকম সতর্কসংকেত না দেখিয়েই পদ্মা ও পলাশে বোমাবর্ষণ করে। প্রথম হামলাতেই বিধ্বস্ত পদ্মা। একটি গোলা এসে পড়ে পদ্মার ইঞ্জিনরুমে। পলাশেও বোমা পড়ে, তবে সেটি সচল ছিল। ওই অবস্থায় পলাশ এগিয়ে যেতে থাকে। একটু পর বিমানগুলো ফিরে এসে আবার পলাশে বোমাবর্ষণ করে। ভারতীয় জঙ্গি বিমান প্যানভেল জাহাজে বোমাবর্ষণ করেনি। পরে প্যানভেলের নাবিকেরা আফজাল মিয়াসহ কয়েকজনকে উদ্ধার করে চিকিত্সার জন্য কলকাতায় পাঠান। আফজাল মিয়ার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়।

আফজাল মিয়া পাকিস্তানি নৌবাহিনীতে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ছুটিতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে গিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। পরে তাঁকে মুক্তিবাহিনীর নৌ উইংয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১২ অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর নৌ উইং গঠিত হয়। এ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর তিনি দুটি অপারেশনে অংশ নেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান