বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালের মার্চে মো. আনোয়ার হোসেন প্রশিক্ষণে ছিলেন। ফলে দেশের পরিস্থিতির খবর সময়মতো পেতেন না। প্রত্যন্ত এলাকায় থেকেও চেষ্টা করতেন দেশের খবর জানার। ১৪ মার্চ তাঁর আত্মীয় ওয়াকার হাসান (বীর প্রতীক) গিয়েছিলেন যশোরে। আনোয়ার হোসেন প্রশিক্ষণ থেকে এক দিনের ছুটি নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। আলাপচারিতায় তিনি ওয়াকার হাসানকে বলেন, দেশের যে পরিস্থিতি, কখন কী হয়, বলা যায় না। যদি কিছু হয় তবে দেশের জন্য লড়াই করবেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশ নেন এবং শহীদ হন।

ছোটবেলা থেকেই আনোয়ার হোসেনের ইচ্ছা ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি করার। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অফিসার্স কোর্সে কোনো বাঙালি যোগ দিলে তাঁকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে দেওয়া হবে, এর নিশ্চয়তা ছিল না। কোর্সে যাঁরা সবচেয়ে ভালো করতেন, তাঁদেরই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়োগ দেওয়া হতো। আনোয়ার হোসেন এইচএসসি পাস করে ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৩ অফিসার্স শর্ট কোর্সে যোগ দেন এবং উত্তীর্ণ হয়ে কমিশন পান। ১৯৭০ সালে তাঁকে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে।

প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল যশোর সেনানিবাসে। এ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ছিলেন বাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল জলিল। অফিসারদের মধ্যে ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন (বীর বিক্রম, পরে মেজর) এবং লে. মো. আনোয়ার হোসেন ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন পাকিস্তানি। ১৯৭১ সালের মার্চে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হতে থাকে। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদের রেডিও শোনা নিষিদ্ধ করা হয়। এ সময় আবার এই ব্যাটালিয়নের অর্ধেক সেনা ছিলেন প্রশিক্ষণের জন্য যশোরের প্রত্যন্ত এলাকায়, অর্ধেক ছুটিতে। ২৫ মার্চ মো. আনোয়ার হোসেনও ছিলেন প্রশিক্ষণস্থলে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের খবর তাঁরা সময়মতো পাননি। এদিকে ২৮ বা ২৯ মার্চ অধিনায়ক রেজাউল জলিল তাঁদের অবিলম্বে সেনানিবাসে ফেরার নির্দেশ দেন। সেদিনই তাঁরা সেনানিবাসে আসেন।

সেনানিবাসে আসার পর রেজাউল জলিল সবাইকে অস্ত্রাগারে অস্ত্র জমা দিতে বলেন। তাঁর নির্দেশে তাঁরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও অস্ত্র জমা দেন। সেদিন তাঁরা বেশির ভাগ সেনা ছিলেন ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। এ জন্য তাঁরা রাতে ঘুমিয়ে ছিলেন। গভীর রাতে যশোর সেনানিবাসে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বালুচ রেজিমেন্ট ও ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (এফএফ) তাঁদের আক্রমণ করে। নিরস্ত্র সেনাদের কয়েকজন ঘুমন্ত অবস্থায়ই শহীদ হন। বেঁচে যাওয়া সেনারা অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধ শুরু করেন। সেনারা অধিনায়ক রেজাউল জলিলকে অনুরোধ জানান বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়ার। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। অন্যদিকে ক্যাপ্টেন হাফিজ ও লে. আনোয়ার সেনাদের সঙ্গে স্বেচ্ছায় একাত্মতা প্রকাশ করেন। তাঁদের নেতৃত্বে সেনারা পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলা করতে থাকেন। ক্যাপ্টেন হাফিজ ও লে. আনোয়ার এই অসম যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দেন। তাঁদের সাহস ও বীরত্বে প্রতিরোধযোদ্ধাদেরও মনোবল বেড়ে যায়। কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। এর মধ্যে প্রতিরোধযোদ্ধাদের অনেকে শহীদ ও অনেকে আহত হন।

একপর্যায়ে তাঁদের গোলাগুলিও কমে আসতে থাকে। এ অবস্থায় হাফিজ ও আনোয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে সেনানিবাস এলাকা ছেড়ে চৌগাছায় একত্র হবেন। এরপর তাঁরা ফায়ার অ্যান্ড মুভ পদ্ধতিতে খোলা মাঠ দিয়ে বেরিয়ে যেতে থাকেন। আনোয়ারও সেভাবে পশ্চিম দিকের খোলা মাঠ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাত্ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ছোড়া গুলি এসে লাগে তাঁর কোমর ও পিঠে। তিনি শহীদ হন। প্রতিরোধযোদ্ধারা তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে পার্শ্ববর্তী এক গ্রামে নিয়ে যান। সেখানে স্থানীয় জনগণ তাঁকে নজরুল ইসলাম কলেজের সামনে সমাহিত করেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান