বিজ্ঞাপন
default-image

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে বিয়ে করেন সাফিল মিয়া। বাড়িতে কৃষিকাজ করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আর ঘরে বসে থাকতে পারলেন না। মা-বাবা, ভাইবোন ও নববধূকে রেখে যোগ দেন প্রতিরোধযুদ্ধে। পরে ভারতে গিয়ে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নেন। প্রথম দিকে কিছুদিন ২ নম্বর সেক্টরের অধীন সীমান্ত এলাকায় গেরিলাযুদ্ধ করেন। এরপর নিয়মিত মুক্তিবাহিনীকে পুনর্গঠিত করা হলে নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর সালদা নদীতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে সাফিল মিয়া শহীদ হন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার অন্তর্গত নদী সালদা। ১৯৭১ সালে সালদা রেলস্টেশন ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। পাকিস্তানি সেনারা সালদা স্টেশন নিয়ন্ত্রণ করত। ওই স্টেশনের পাশের নয়নপুরে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘাঁটি। সেখানে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি দল এবং অদূরেই কুটি ও কসবা এলাকায় ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩৩ বালুচ রেজিমেন্টের অবস্থান। সেপ্টেম্বরের শেষ দিন মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি দল একযোগে নয়নপুর, সালদা রেলস্টেশন, কসবা, কুটিসহ বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ চালায়।

মুক্তিবাহিনীর একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন মেজর সালেক চৌধুরী। এই দলে ছিলেন সাফিল মিয়া। তাঁরা সালদা নদী অতিক্রম করে সালদা রেলস্টেশনের পশ্চিমে একটি গোডাউন-সংলগ্ন জায়গায় অবস্থান নিয়ে আক্রমণ শুরু করেন। পাকিস্তানি সেনারাও আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল। তারা সমস্ত শক্তি দিয়ে সাফিল মিয়াদের দলের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেও তেমন সুবিধা করতে পারছিলেন না। তাঁদের অগ্রযাত্রা থেমে যায়। অন্যদিকে নয়নপুরে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর অপর দলের প্রচণ্ড আক্রমণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। এরপর তারা পিছু হটে সালদা রেলস্টেশনের মূল ঘাঁটিতে গিয়ে অবস্থান নেয়। এতে সালদা রেলস্টেশনের পাকিস্তানি প্রতিরক্ষাশক্তি আরও বেড়ে যায়। নয়নপুর থেকে আসা পাকিস্তানি সেনারা মূল দলের সঙ্গে একত্র হয়ে সাফিল মিয়াদের দলের ওপর তীব্র গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলতে থাকে। ১ অক্টোবর সকাল নয়টার দিকে সাফিল মিয়াদের দলের গোলা শেষ হয়ে যায়। তখন তাঁরা চরম বিপদে পড়েন। ক্রমে মুক্তিবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি বাড়তে থাকে।

এক জায়গায় সাফিল মিয়াসহ কয়েকজন অবস্থান নিয়ে বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলা করছিলেন। সাফিল মিয়ার অসাধারণ বীরত্ব ও রণকৌশলে মুক্তিবাহিনী চরম বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায়। একপর্যায়ে একদল পাকিস্তানি সেনা তাঁদের প্রায় ঘেরাও করে ফেলে। পাকিস্তানি সেনাদের প্রচণ্ড গুলির কারণে তাঁদের কেউ মাথা তুলতে পারছিলেন না। ঠিক এ সময় এক ঝাঁক গুলি এসে লাগে সাফিল মিয়াসহ কয়েকজনের শরীরে। সাফিল মিয়া বুক ও হাতে গুলিবিদ্ধ হন। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিভে যায় তাঁর জীবনপ্রদীপ। সেদিন শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেও মুক্তিবাহিনী সালদা রেলস্টেশন দখল করতে ব্যর্থ হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা পাশের মন্দভাগ এলাকায় পশ্চাদপসরণ করেন। এ যুদ্ধে আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও অনেকে আহত হন। সহযোদ্ধারা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাহিত করেন বাংলাদেশের মাটিতেই, কসবার কুল্লাপাথরে। যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান