বিজ্ঞাপন
default-image

বরিশাল জেলা সদরের উত্তর দিকে আড়িয়াল খাঁ নদের উপকূলে বাবুগঞ্জ থানা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মাঝেমধ্যে সেখানে হানা দিত। সড়ক বা নদীপথে এসে তারা সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে আবার চলে যেত। সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে আলতাফ হোসেনের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা এসে অবস্থান নেয় বাবুগঞ্জে। অক্টোবর মাসের ২ বা ৩ তারিখে (১৬ আশ্বিন) মুক্তিযোদ্ধারা খবর পেলেন বরিশাল থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকারের একটি দল সড়কপথে বাবুগঞ্জে আসছে। তাত্ক্ষণিকভাবে তাঁরা তাদের অ্যামবুশ করার সিদ্ধান্ত নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা আলতাফ হোসেনের নেতৃত্বে বাবুগঞ্জ-বরিশাল সড়কের এক স্থানে অ্যামবুশ করে আড়ালে বসে থাকেন। কিছুক্ষণ পর তাঁরা দেখতে পান, পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা নিশ্চিন্তে এগিয়ে আসছে। সামনে মুক্তিযোদ্ধারা থাকতে পারে, ওরা কল্পনাও করেনি। তারা অস্ত্রের আওতায় আসামাত্র একসঙ্গে গর্জে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের সব অস্ত্র। সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনজন পাকিস্তানি সেনা লুটিয়ে পড়ে।

তারপর কয়েকটি মুহূর্ত কেটে গেল। হকচকিত পাকিস্তানি সেনারা দ্রুত অবস্থান নিয়ে শুরু করল পাল্টা গুলি। আলতাফ হোসেন ও তাঁর সহযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা আক্রমণ মোকাবিলা করছেন। হঠাত্ একটি গুলি এসে লাগে আলতাফ হোসেনের বুকে। সহযোদ্ধারা যে তাঁকে উদ্ধার করবেন, সে সুযোগও নেই। বুকে গুলি লাগলেও আলতাফ হোসেন দমে গেলেন না। গুলিবিদ্ধ অবস্থায়ই আরও কিছুক্ষণ গুলি চালিয়ে গেলেন। গুলি চালাতে চালাতে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। সেখানে যুদ্ধ চলে অনেকক্ষণ। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা জয়ী হন। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা পিছু হটে বরিশালে পালিয়ে যায়। সহযোদ্ধারা মুমূর্ষু অবস্থায় আলতাফ হোসেনকে উদ্ধার করে চিকিত্সকের কাছে নিয়ে যান। পরদিন সকালে তিনি মারা যান। সেদিন যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চারজন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়।

আলতাফ হোসেন ১৯৭১ সালে ছিলেন ২১-২২ বছরের যুবক। ১৯৬৮ সাল থেকে তিনি স্থানীয় বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে, বিশেষত জোতদার ও মহাজনী শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি প্রতিরোধযুদ্ধে যোগ দেন। একপর্যায়ে স্থানীয় যুবকদের সংগঠিত করে একটি দল গঠন করে তাঁদের নিয়ে ভারতে যান। সেখানে প্রশিক্ষণে দেরি হওয়ায় আবার নিজ এলাকায় চলে আসেন। পরে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করতে থাকেন। পরবর্তী সময়ে তাঁকে ও তাঁর দলকে মুক্তিবাহিনীর ৯ নম্বর সেক্টরের ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরের দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আলতাফ হোসেন উজিরপুর এলাকায় রায়েরহাট, আলতা, শকুন্দিয়া এবং সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বানারীপাড়া থানা আক্রমণে সাহস ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান