বিজ্ঞাপন
default-image

সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের আট দিনের কানাডা সফর শেষে ২৬ অক্টোবর প্রকাশিত দুই দেশের যুক্ত বিবৃতিতে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গও গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পায়। বাংলাদেশ সমস্যার জরুরি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য দুই দেশ আহ্বান জানায় এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে সংযত হতে অনুরোধ করে। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের অধিবাসীদের অধিকার ও ন্যায়সংগত স্বার্থ এবং শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনে সুযোগ দেওয়ার প্রশ্নটি সামনে রেখে সমস্যার সমাধান করতে হবে।

বিবৃতিতে দুই প্রধানমন্ত্রী পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রে সংগত ও স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশে৵ গঠনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জরুরি প্রয়োজনের ওপর গুরুত্ব দেন।

দুজন নোবেল বিজয়ীসহ ফ্রান্সের ৮০ জনের বেশি বিশিষ্ট নাগরিক এই দিন দেশটির সরকারের কাছে এক ইশতেহারে পাকিস্তানকে অবিলম্বে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ করার আহ্বান জানান। নোবেল বিজয়ীরা হলেন পদার্থবিজ্ঞানী আলফ্রে কাস্তলে এবং অণুজীববিজ্ঞানী আঁদ্রে লোফ। লেখক, সাংসদ ও ধর্মীয় নেতারা এই ইশতেহারে স্বাক্ষর করেন।

বেলজিয়াম সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ব্রাসেলসে বলেন, বাংলাদেশের জনগণ তাঁদের সমস্যা নিয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে বাংলাদেশি শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টির দায়িত্ব শান্তিতে আগ্রহী বিশ্বের সব দেশের। তিন দিনের বেলজিয়াম সফর শেষে অস্ট্রিয়ায় যাত্রার আগে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।

ইন্দিরা বলেন, ভারত আলোচনার ওপরই জোর দিচ্ছে। তবে আলোচনায় কিছু ভিত্তি থাকা দরকার। পূর্ববঙ্গে কিছু ঘটনার কারণে বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। অথচ কষ্ট ভোগ করছে ভারত।

মিসরের পাকিস্তানি দূতাবাস থেকে যুক্তরাজ্যে চলে আসা পক্ষত্যাগী বাঙালি কূটনীতিক ফজলুল করিম লন্ডনে এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তান সরকারের নীতির প্রতিবাদে তিনি কাজে ইস্তফা দিয়েছেন।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

২ নম্বর সেক্টরে কয়েকটি স্থানে এই দিন মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। সীমান্তবর্তী কসবা ছাড়াও কায়েমপুর, সালদা নদী, নয়নপুর ও চৌদ্দগ্রাম এলাকায় মুখোমুখি যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে পাকিস্তানিদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। ২৭ অক্টোবর ইত্তেফাক ‘কসবায় ভারতীয় গোলাবর্ষণ অব্যাহত’ শিরোনামে খবর প্রকাশ করে।

৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরে সিলেট অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা এই দিন সীমান্ত এলাকার গোয়ান ও রাউত গ্রামে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু ধ্বংসের অভিযানে যান। সেতু দুটি পাহারায় ছিল রাজাকারদের একটি দল। মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে রাজাকাররা আক্রমণ করে। এরপর দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধে কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয়। দু-তিন মুক্তিযোদ্ধাও হতাহত হন।

এই দিন ৭ নম্বর সেক্টরের রাজশাহী অঞ্চলে কিছু রাজাকার অস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের পর তাদের ৭ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তরে পাঠানো হয়।

৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা দর্শনা থেকে সাত মাইল দূরে আন্দুলবাড়িয়ায় পাকিস্তান বাহিনীর সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকারবাহী একটি ট্রেন অ্যামবুশ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় পাকিস্তানিদের নজরদারি ফাঁকি দিয়ে লাইনে মাইন পুঁতে রেখেছিলেন। ট্রেনটি মাইনের ওপর আসামাত্র বিস্ফোরিত হয়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকার হতাহত হয়।

এই সেক্টরে আরও কয়েকটি স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা অভিযান পরিচালনা করেন। একটি দল যশোর-বেনাপোল সড়কের ঝিকরগাছার গদখালী-নাভারন অংশে সড়কের পাশে টেলিফোন লাইন ধ্বংস করলে যশোর–বেনাপোল টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে। আরেকটি দল বাগআঁচড়ায় আক্রমণ করলে পাকিস্তানি বাহিনীর দুজন হতাহত হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল ঝিনাইদহের বেথুলী গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করে। সেনা ও রাজাকার সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর ৬০-৬৫ জনের দলটি অ্যামবুশের আসামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে তাদের আক্রমণ করেন। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। কয়েকজন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণও করে।

কুষ্টিয়া অঞ্চলে এই দিন কিছু রাজাকার চীনা অস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের পর তাদের ৮ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তরে পাঠানো হয়।

মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে এক বুলেটিনে এই দিন বলা হয়, কয়েক দিন আগে একদল নৌ মুক্তিযোদ্ধা সুন্দরবনের কয়রায় বিস্ফোরকের সাহায্যে পাকিস্তান ন্যাশনাল শিপিং করপোরেশনের লানশিয়া নামে একটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। রংপুর অঞ্চলের একদল মুক্তিযোদ্ধা লালমনিরহাট-মোগলহাটের মধ্যবর্তী এলাকায় রেললাইন তুলে ট্রেন চলাচল ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর আট; ইত্তেফাক, ঢাকা, ২৭ অক্টোবর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ২৭ ও ২৮ অক্টোবর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান