বিজ্ঞাপন
default-image

দিল্লিতে একটি কূটনৈতিক সূত্র ১৭ অক্টোবর সাংবাদিকদের জানায়, ভারতের বিরুদ্ধে কোনো হঠকারী সামরিক অভিযানের ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়েছে। তেহরানে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নির সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক বৈঠকের সময় সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন।

ইরানে রাজতন্ত্রের আড়াই হাজার বছর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তাঁরা তেহরানে গিয়েছিলেন।

ভারতে সফররত যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো এই দিন বাংলাদেশে এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টির আহ্বান জানান, যাতে শরণার্থীরা দ্রুত নিরাপদে দেশে ফিরে যেতে পারেন। তাঁর সম্মানে দিল্লিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি আয়োজিত ভোজসভায় তিনি এ অভিমত জানান। তিনি বলেন, এই গুরুতর সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ প্রয়োজন। পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে পুরো উপমহাদেশে, এমনকি তার বাইরেও শান্তির পক্ষে বিপদ দেখা দিতে পারে।

ভোজসভায় ভি ভি গিরি বলেন, কেবল স্থায়ী ও কার্যকর সমাধানের মাধ্যমেই পূর্ববঙ্গের জনগণের মানবিক অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব।

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম জলন্ধরে বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার মীমাংসা না হওয়া অব্দি সীমান্ত থেকে ভারত সৈন্য সরাবে না। এ ব্যাপারে ভারত কোনো আন্তর্জাতিক চাপ গ্রাহ্য করবে না।

দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ৵ সূত্র সাংবাদিকদের জানায়, ২৪ অক্টোবর থেকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানি—ইউরোপের এই পাঁচ দেশ সফর করবেন। এই সফরে তাঁর আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ প্রাধান্য পাবে। তাঁর বক্তব্য হবে, ‘বাংলাদেশ একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। পাকিস্তানের মতান্ধতা ও অপকৌশল এশিয়া ও বিশ্বের শান্তি বিপন্ন করে তুলেছে। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান চাই, শরণার্থীদের সসম্মানে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা চাই।’

গেরিলা অভিযান

১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি দল এই দিন ফেনীতে ভারত সীমান্তবর্তী আলাদা তিনটি স্থানে অভিযান পরিচালনা করে। একটি দল পাকিস্তানি সেনাদলকে দেবপুরে অ্যামবুশ করলে কয়েকজন হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধাও গুরুতর আহত হন। দ্বিতীয় দলটি ভোরে পূর্ব দেবপুরে আরেকটি পাকিস্তানি সেনাদলকে অ্যামবুশ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর তিনজন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় দলটি জগন্নাথ সোনাপুর পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহল দলকে অ্যামবুশ করে। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও মিলিশিয়া হতাহত হয়।

২ নম্বর সেক্টরের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা রাত আটটার দিকে ঢাকায় মতিঝিলের কাছে নটর ডেম কলেজসংলগ্ন সেতুটি বিস্ফোরক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করেন। এ সময় টহলরত একটি ছোট পাকিস্তানি সেনাদল সেখানে হাজির হলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপরও অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।

একই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল কুমিল্লার রমজানপুরে আরেকটি টহল দলকে অ্যামবুশ করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন।

৫ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা টানা কয়েক দিন পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধের পর সুনামগঞ্জের ছাতক থেকে এদিন ভোরে পর্যায়ক্রমে বালিউরায় এসে একত্র হন। মুক্তিবাহিনীর এফএফসহ আলফা ও ব্রাভো কোম্পানি অবস্থান ছেড়ে গেছে দেখে এই দিন পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ধাওয়া করতে জোড়াপানি-মৌলা হয়ে ভারত-সীমান্তের দিকে অগ্রসর হয়। তখন আলফা, ব্রাভো ও এফএফ কোম্পানি বালিউরায় অবস্থান নিয়ে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এদিন বিকেল পর্যন্ত চলা যুদ্ধে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাতবরণ করেন। ২৫-৩০ জন মারাত্মক আহত হন। আহতদের বহু কষ্টে বাঁশতলায় পাঠানো হয়। সেখানে তাঁদের সমাহিত করা হয়। বিকেলে পাকিস্তানি বাহিনী ছাতকের দিকে ফিরে যায়।

৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরের আলাদা দুটি স্থানে এদিন যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এদিন দশাতিনায় পাকিস্তানি বাহিনীর অ্যামবুশের আওতায় পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা বিচক্ষণতার সঙ্গে সে হামলা মোকাবিলা করে নিরাপদ স্থানে সরে যান। তবে এর আগে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি গুলির ঘটনায় পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অক্ষত ছিলেন। গোলন্দাজ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় নিরাপদে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে যান।

ভারত সীমান্তবর্তী বিশাহারীতে আরেকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এখানে পাকিস্তানি বাহিনী মর্টার ও ভারী অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। যুদ্ধে দু-তিনজন মুক্তিযোদ্ধা সামান্য আহত হন, অবশ্য বড় কোনো ক্ষতি তাঁদের হয়নি।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই ও আট; সম্মুখযুদ্ধ ১৯৭১: মুক্তিযোদ্ধাদের কলমে, সম্পাদনা মতিউর রহমান, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; ইত্তেফাক, ঢাকা, ১৮ অক্টোবর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত ১৮ ও ১৯ অক্টোবর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান