বিজ্ঞাপন
default-image

ইরানে রাজতন্ত্রের আড়াই হাজার বছর পূর্তি উপলক্ষে সেখানে সফররত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৫ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি, যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো এবং রুমানিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোলাই চসেস্কুর সঙ্গে তেহরানের পারসি প্যালেসে আলাদা আলাদা বৈঠক করেন। তাঁরা সবাই উৎসবে যোগ দিতে তেহরানে যান। নিকোলাই পদগোর্নির সঙ্গে ইয়াহিয়া প্রায় দুই ঘণ্টা আলোচনা করেন। পদগোর্নির কাছে তিনি ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে সেনাসমাবেশের কথা স্বীকার করে বলেন, আত্মরক্ষার জন্যই তিনি এসব করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ এই দিন সাংবাদিকদের জানান, সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির সদস্যরা পাকিস্তানকে দেওয়া সাহায্যের পরিমাণ পুরোপুরি কমিয়ে দিতে ভোট দিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি এবং শরণার্থীদের দেশে ফিরে যাওয়ার কথা যতক্ষণ না প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসের সামনে ঘোষণা করতে পারছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত পাকিস্তানকে দেওয়া সব বিদেশি সাহায্য নিষিদ্ধ করার পক্ষে কমিটি ভোট দিয়েছে।

নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ঢাকা থেকে পাঠানো এক খবরে বলা হয়, ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ বাংলাদেশে সেনা নামিয়ে যে সন্ত্রাসের সূচনা করেছিলেন, বাংলাদেশে তা এখন স্থায়ী রূপ নিয়েছে। ভারতে যাওয়া শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনার মতো পরিস্থিতির সম্ভাবনা সুদূর।

ভারতে নিয়োজিত উত্তর ভিয়েতনামের কনসাল জেনারেল নুয়েন থাট ভু এদিন দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, উত্তর ভিয়েতনামের জনসাধারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, পূর্ব বাংলার জনসাধারণের সংগ্রামে ভিয়েতনামের পূর্ণ সহযোগিতা আছে।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ইয়াহিয়ার চাতুর্য

স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেন, ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে রাজনৈতিক চাতুর্য শুরু করেছেন। আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় তিনি দেখাতে চাইছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণ তাঁর দয়ার ওপর নির্ভর করছে। তিনি বলেন, শেখ মুজিবকে ইয়াহিয়া হত্যা করবেন না, এমন তথ্য তাঁদের কাছে নেই।

মিসরের আল আহরাম পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে ক্লোভিমা ম্যাক সাউদ লিখেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে নাকি প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন যে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হবে না।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে এই দিন বাংলাদেশ থেকে দিল্লি পদযাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ৩৬ জন ছাত্র-যুবক ভোরে পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরের কালীশ্বরী বালিকা বিদ্যালয় থেকে এই পদযাত্রা শুরু করেন। একনাগাড়ে ১০ মাইল হেঁটে তাঁদের সাড়ে তিন মাসব্যাপী পদযাত্রার প্রথম দিন গোকর্ণে শেষ হয়। ৩০ জানুয়ারি গান্ধী প্রয়াণদিবসে দিল্লির রাজঘাটে গান্ধীর সমাধিতে এর সমাপ্তি হবে। অখিল ভারত শান্তি সেনা মণ্ডলের সহায়তায় এই পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।

গেরিলা অভিযান

১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল ১৫ অক্টোবর ফেনীর ছাগলনাইয়া, গুতুমা, পরশুরাম, চিতলিয়া, বল্লভপুর, দারোগাহাটসহ কয়েকটি স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছোট ছোট আক্রমণ পরিচালনা করে। এসব আক্রমণে পাকিস্তানি সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকাররা হতাহত হয়। এ ছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর তিনটি বাংকারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার দক্ষিণে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি প্রতিরক্ষা অবস্থানের কাছে বারচর গ্রামে অ্যামবুশ পাতেন। এক ঘণ্টা পর একদল পাকিস্তানি সেনা তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে ফেরার পথে অ্যামবুশের আওতায় পড়ে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।

৫ নম্বর সেক্টরে সুনামগঞ্জের ছাতকে ১৪ অক্টোবর শুরু হওয়া যুদ্ধ এদিনও অব্যাহত থাকে। পাকিস্তানি বাহিনী তিনটি হেলিকপ্টার দিয়ে এই দিন সকাল থেকে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির অবস্থানে মেশিনগানের গুলি করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা সে আক্রমণ প্রতিহত করেন। জেড ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম, সেনাপ্রধান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) এই দিন সুনামগঞ্জের বালিউরায় এসে যুদ্ধ পরিদর্শন করেন।

৭ নম্বর সেক্টরের বগুড়া অঞ্চলের একদল মুক্তিযোদ্ধা বগুড়া-সান্তাহার রেললাইনের একটি সেতুর কাছে অতর্কিতে হামলা করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।

৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমানের (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম, সেনাপ্রধান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল) নেতৃত্বে চুয়াডাঙার দামুড়হুদার ধোপাখালীতে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ চালান। দুই পক্ষের মুখোমুখি যুদ্ধে সেনা ও রাজাকার মিলে পাকিস্তানি বাহিনীর সাতজন নিহত এবং অনেকে আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর হাবিলদার আবদুল গফুর ও নায়েক শহীদ আলী শহীদ হন। আহত হন ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান।

এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা যশোরের ঝিকরগাছা থেকে দশতিনামুখী সড়কে রাজাকারদের অ্যামবুশ করেন। ঝিকরগাছায় ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের প্রতিরক্ষা অবস্থান। রাজাকারেরা এদিন পাকিস্তানি সেনাদের জন্য দশতিনা থেকে কয়েকটি গরুর গাড়িতে করে খাদ্যসামগ্রী ও রসদ নিয়ে ঝিকরগাছা যাচ্ছিল। পথে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করেন। এমন আকস্মিক আক্রমণ রাজাকাররা প্রতিরোধ করতে পারেনি। অতর্কিত আক্রমণে তিনজন রাজাকার আহত হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই, সাত ও আট; ইত্তেফাক, ঢাকা, ১৬ অক্টোবর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত ১৬ ও ১৭ অক্টোবর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান