পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার ৮ থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ে ১৫ জুলাই মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন সেক্টরের অধিনায়কেরা বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকে তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে শপথ নেন। এর মধ্য দিয়ে সাত দিনব্যাপী পরিকল্পিত সেক্টরের অধিনায়কদের সম্মেলন আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়।
ভাসানী ন্যাপ এবং চীনঘেঁষা আটটি বাম দল এদিন বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি নামে একটি নতুন ফ্রন্ট গঠন করে। ফ্রন্ট গঠনের পর এক বিবৃতিতে জানানো হয়, বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিসংগ্রামে লিপ্ত অন্য সব শক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং পূর্ণ সহযোগিতা বজায় রেখে কমিটি এ সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত দলগুলো হলো কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি, শ্রমিক কৃষক কর্মী সংঘ, কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ (হাতিয়ার গোষ্ঠী), পূর্ব বাংলা কৃষক সমিতি, পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন, পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন।
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান ফ্রন্ট গঠনের সংবাদে মুজিবনগর থেকে সংবাদপত্রে পাঠানো এক বিবৃতিতে প্রতিক্রিয়া জানান। বিবৃতিতে তিনি বলেন, জনযুদ্ধের এই সময় নির্বাচনে কোনো আসন না পাওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর এ ধরনের পদক্ষেপ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং চীনকেই শক্তিশালী করবে। তিনি তাদের বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে মৌলভীবাজারের শাহবাজপুরে একদল মুক্তিযোদ্ধার গেরিলা অভিযানে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
পাকিস্তানকে সাহায্য স্থগিত রাখার প্রস্তাব
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটি বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্যদান স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। যুক্তরাষ্ট্র সরকার চলতি আর্থিক বছরে পাকিস্তানকে ১১ কোটি ৮ লাখ ডলার সাহায্য দেওয়ার প্রস্তাব করলে কমিটি ১৭-৬ ভোটে তা বাতিল করে দেয়। সিনেটের প্রভাবশালী সদস্যরা পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়ার বিরোধিতা করেন। সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ ও উইলিয়াম স্যাক্সবি সামরিক সাহায্যদানের বিরোধিতা করে আনা সংশোধনী প্রস্তাবের প্রতি ৩২ জন সিনেটর সমর্থন জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শরণার্থীবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান এবং ডেমোক্র্যাট পার্টির সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ওয়াশিংটনে এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তানের জন্য অস্ত্রবোঝাই জাহাজগুলোকে কী করে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দর ছেড়ে যেতে দেওয়া হলো, সে সম্পর্কে পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্যাখ্যা মোটেই সন্তোষজনক নয়। কম্পট্রোলার জেনারেল এলমার স্ট্যাটনকে তিনি ঘটনাটি অনুসন্ধান করে দেখার অনুরোধ জানান।
খবর এসেছিল, পদ্মা জাহাজ পাকিস্তানের জন্য সমরসম্ভার বয়ে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের বাল্টিমোরে আসছে। ১৪ জুলাই পদ্মা বাল্টিমোরে এসে পৌঁছায়। বাল্টিমোর বন্দরে কয়েকজন নৌকায় বোঝাই হয়ে জাহাজটি থামাতে যায়। পুলিশ তাদের সাতজনকে গ্রেপ্তার করে। যুক্তরাষ্ট্রের বন্দর কর্মী ইউনিয়ন পদ্মায় কিছু না তোলার জন্য বন্দর কর্মীদের অনুরোধ জানায়।
ভারতের সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ওম মেহতা ক্রেমলিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট মিসেস বাগদার নাসসুদ্দনোভার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। মিসেস বাগদার তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেন, পাকিস্তানকে সোভিয়েত অস্ত্র সরবরাহ করা হবে না।
ব্রিটেনকে নিয়ে বিরূপ
ইসলামাবাদে এক সরকারি হ্যান্ডআউটে বলা হয়, পাকিস্তান সরকার কমনওয়েলথের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের বাঞ্ছনীয়তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ব্রিটেনের আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে কমনওয়েলথের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখা সংগত কি না, সেটিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার কথা বলা হয়। হ্যান্ডআউটে আরও বলা হয়, ব্রিটেনের নজির অনুসরণ করে কমনওয়েলথের আরও কয়েকটি দেশও পাকিস্তানের ব্যাপারে অবাস্তব মনোভাব গ্রহণ করেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল হয়ে উঠেছে।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশ সফররত কানাডার সংসদীয় প্রতিনিধিদল চট্টগ্রাম শহরের প্রধান বৌদ্ধমন্দির পরিদর্শনের পর চট্টগ্রাম ক্লাবে ব্রিটিশ নাগরিক এবং কানাডার মিশনারিদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এরপর তাঁরা শহরের কয়েকটি এলাকা দেখে ঢাকায় ফিরে করাচির পথে রওনা দেন।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর চার; ইত্তেফাক, ১৬ ও ১৭ জুলাই ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ১৬ ও ১৭ জুলাই ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান