দিল্লি ও কলকাতার কূটনৈতিক সূত্র ২৭ অক্টোবর সাংবাদিকদের জানায়, ইউরোপের তিনটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র পাঠাচ্ছে। দুই মাস ধরে এসব অস্ত্র মুক্তিবাহিনীর কাছে আসছে। সম্প্রতি সরবরাহও বেড়েছে। প্রথম দিকে এসেছিল খুব হালকা অস্ত্র। এখন ভারী অস্ত্রশস্ত্র আসতে শুরু করেছে। এসব অস্ত্রের কিছু টাকা দিয়ে কেনা, কিছু সাহায্য হিসেবে পাওয়া।
পাকিস্তান সরকার এসব অস্ত্র সরবরাহের তথ্য
জানার পর বিভিন্ন পশ্চিমা রাষ্ট্রকে বিষয়টি অনানুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে। তারা এখনই প্রকাশ্যে কিছু বলতে নারাজ। কিছুদিন ধরে ইসলামাবাদ হয়ে কলকাতায় আসা কূটনীতিকদের কারও কারও মতে, এর পেছনে দুটি কারণ আছে: ১. সে ক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহের সব দায় ভারতের ওপর চাপানো যাবে না। ২. তাহলে বিশ্ব এবং দেশবাসীর কাছে স্বীকার করতে হবে, কিছু ইউরোপীয় রাষ্ট্রও মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য দিচ্ছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর এই দিন কলকাতায় সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ক্রমশ সাফল্য অর্জন করছে। তাদের দ্রুত জয় সুনিশ্চিত। দুই দিন ধরে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকের পর তিনি এই মন্তব্য করেন।
মুজিবনগরে এদিন আবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা শুরু হয়। সভায় দলের সাংগঠনিক প্রশ্ন এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা অসমাপ্ত থাকে।
বার্তা সংস্থা এপি পশ্চিম পাকিস্তানের ওয়াকিবহাল মহলের সূত্র উদ্ধৃত করে এদিন জানায়, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন সামরিক বিচার নভেম্বর পর্যন্ত মুলতবি রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের সাহায্যার্থে ৩১ অক্টোবর মুম্বাইয়ে একটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে বাংলাদেশ ফুটবল দলের ১৮ জন খেলোয়াড় এদিন মুজিবনগর থেকে বোম্বাইয়ের পথে রওনা হন। দলের নেতৃত্ব দেন জাকারিয়া পিন্টু।
মার্শাল টিটোর সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ
যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো ২৭ অক্টোবর এক টিভি সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ এবং এর শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রশ্নটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার কিংবা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। সপ্তাহব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফরের আগে সিবিএস টেলিভিশনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা হিসেবে বাংলাদেশ সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের ওপর জোর দেন।
অস্ট্রিয়ায় সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশটির প্রেসিডেন্ট ফ্রান্স জোনাস এবং চ্যান্সেলর ব্রুনো ক্রাইস্কির সঙ্গে আলোচনা করেন। এ আলোচনায় তাঁরা বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা পান। তাঁরা সমস্যাটির রাজনৈতিক সমাধান কামনা করেন। ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে ব্রুনো ক্রাইস্কি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে রাজনীতিতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা উপনির্বাচনে অংশগ্রহণকারী কনভেনশন মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ বখতিয়ারের বিরুদ্ধে এদিন অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে তিনি নিহত হন। এই সেক্টরের অন্য গেরিলা দল চট্টগ্রামে একটি চীনা রেস্তোরাঁয় বোমা বিস্ফোরণ ঘটান। রেস্তোরাঁটিতে পাকিস্তানি সেনা ও পাকিস্তানপন্থীদের আনাগোনা ছিল। ঘটনায় কয়েক ব্যক্তি আহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা শহরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল সন্ধ্যায় গভর্নর হাউসের (বর্তমান বঙ্গভবন) দক্ষিণ গেটের সামনে একদল পাকিস্তানি সেনাকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করলে কয়েকজন হতাহত হয়। অন্য আরেকটি গেরিলা দল ভোরে মতিঝিল সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুলের কাছে টহলরত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের ছোড়া একটি শক্তিশালী বোমা প্রধান শিক্ষিকার বাসভবনে বিস্ফোরিত হলে কয়েকজন হতাহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা যশোরের দশাতিনায় হামলা চালিয়ে ১০ জন পাকিস্তানি সেনাকে হতাহত করেন। দুজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কুষ্টিয়া জেলার বাহিরমদীতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন। এখানে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে পাকিস্তানিরা আক্রমণ করলে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকিস্তানিদের একজন নিহত ও একজন আহত হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা এদিন চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রংপুর ও যশোর সীমান্তে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে গোলাবর্ষণ করেন। পাকিস্তান সরকার ভারতের কাছে অভিযোগ করে বলে যে ভারতীয় সেনাবাহিনী সীমান্ত লঙ্ঘন করে পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে বোমাবর্ষণ করছে। ভারত এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে।
পাকিস্তানের তৎপরতা
ঢাকার একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা রাওয়ালপিন্ডি অফিস থেকে পাঠানো এক রিপোর্টে বলে, ২৬ অক্টোবর পাকিস্তান-ভারত সংকট নিরসনে বিশ্ব শক্তিবর্গের উদ্বেগ, জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের মধ্যস্থতার প্রস্তাব, কয়েকজন পাকিস্তানি নেতার বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তির সুপারিশ এবং কিছু সংবাদপত্রের খবরে আরেকটি তাসখন্দ সম্মেলন অনুষ্ঠানের আভাসের প্রেক্ষাপটে এ সপ্তাহে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের উদ্বেগ সামান্য কমেছে। শেখ মুজিবের মুক্তির ফলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার পথ প্রশস্ত হবে বলে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মাস্টার খান গুলের বিবৃতি এই মাসে দুবার পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।
ভুট্টোর মিসরে উপস্থিতি এবং তাঁর ফ্রান্স সফরকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানে নানা জল্পনা চলছে। প্রসঙ্গত, মিসরের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ এবং ভারতের ভালো সম্পর্ক রয়েছে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর আট; ইত্তেফাক, ঢাকা, ২৮ অক্টোবর ১৯৭১; দ্য টাইমস, লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ২৮ অক্টোবর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত ২৮ ও ২৯ অক্টোবর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান