বিজ্ঞাপন
default-image

সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স ৩০ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে বার্ষিক আলোচনাকালে বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে একমত হন। ভারতে বিপুল শরণার্থীর কারণে বেড়ে যাওয়া উত্তেজনা নিবারণের প্রয়োজন সম্পর্কে দুজনের মতৈক্য হয়। দুই পক্ষই স্বীকার করে, ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতি বিপজ্জনক, তবে যুদ্ধ সমাধান নয়।

আগের দিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে এবং এক সপ্তাহ আগে নিউইয়র্কে উইলিয়াম রজার্সের সঙ্গে আন্দ্রে গ্রোমিকোর আলোচনাতেও শরণার্থী প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছিল। জানা যায়, দুই পক্ষই ভারত ও পাকিস্তানকে সংযত থাকার এবং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার পরামর্শ দেবে।

নিউইয়র্কে প্রায় ৫০টি জোটনিরপেক্ষ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের অনুমোদিত ইশতেহারে বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়। ইশতেহারে বলা হয়, ভারতে শরণার্থীরা স্রোতের মতো প্রবেশ করায় ভারতের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়েছে। তাদের নিরাপদে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এক বছর আগে জাম্বিয়ার লুসাকায় এই নিরপেক্ষ গোষ্ঠী গঠিত হয়। এ বছর সভাপতিও জাম্বিয়া।

ব্রিটেনের দ্য টাইমস পত্রিকায় এই দিন এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, পূর্ববঙ্গের হিন্দু ও মুসলমান অধিবাসীদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে এমন একটি সরকার গঠন করাই আবশ্যক। আওয়ামী লীগ জনগণের স্বাভাবিক মুখপাত্র বলে পাকিস্তানের বিগত নির্বাচন প্রমাণ করেছে। গত মার্চ মাসের তুলনায় ভিন্ন পরিবেশে আওয়ামী লীগ নতুনভাবে আলোচনা করতে পারে। সে আলোচনায় শেখ মুজিবুর রহমানকে কারামুক্ত হয়ে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিতে হবে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের শান্তি কমিটি এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অপরাপর নেতাদের প্রতি উৎপীড়ন বন্ধ করার জন্য আহ্বান জানায়। বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর জীবন সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। কমিটি সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে পূর্ব বাংলার জনগণের ইচ্ছা, অধিকার ও স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানায়।

পাকিস্তানের নাটক

পাকিস্তান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এ দিন বলেন, ২৮ সেপ্টেম্বর দিল্লির পাকিস্তানি হাইকমিশনের চারজন বাঙালি কর্মীকে সপরিবার হরিয়ানার কাছে একটি চেকপোস্ট থেকে ভারতীয় পুলিশ আটক করে অজ্ঞাত স্থানে রেখেছিল। তাঁরা সরকারি নির্দেশে একটি বাসযোগে পাকিস্তান প্রত্যাবর্তন করছিলেন। ঘটনাস্থলে একজন আলোকচিত্রী রাখা হয়েছিল বলে বোঝা যায় যে এটি ভারতের পূর্বপরিকল্পিত। ভারতের এ ধরনের কাজ কূটনৈতিক শিষ্টাচারের পরিপন্থী। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্তানে নিয়োজিত ভারতের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে ডেকে এর প্রতিবাদ জানায়। এই চার কর্মচারীকে পাকিস্তান হাইকমিশন পাকিস্তানে পাঠানোর সময় তাঁরা হরিয়ানা সীমান্তে বাস থেকে নেমে পড়েন এবং পাকিস্তানি পক্ষ ত্যাগ করে পরে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আনুগত্য ঘোষণা করেন।

বাংলাদেশ সফররত পাকিস্তানের তেহরিকে ইশতেকলাল পার্টির প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান এ দিন ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সাংসদদের সবাইকে ক্ষমা করে স্বপদে পুনর্বহাল করা উচিত। যাঁরা নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন, তাঁদেরই ক্ষমতায় আসা উচিত।

গেরিলা অভিযান

২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা এ দিন লেফটেন্যান্ট মেহবুবুর রহমানের (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল) নেতৃত্বে গভীর রাতে কুমিল্লার দক্ষিণে বুড়িচংয়ের কংসতলায় পাকিস্তানি সেনাঘাঁটিতে আক্রমণ করেন। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার এ হামলায় হতাহত হয়।

এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য দুটি দল পাকিস্তানি বাহিনীর নয়ানপুর ঘাঁটিতে হামলা করে। একটি দল আর্টিলারির গোলা নিক্ষেপ করে। অন্য দল পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা নয়ানপুর ছেড়ে শালদা নদী রেলস্টেশনের মূল ঘাঁটিতে আশ্রয় নেয়।

২ নম্বর সেক্টরের ঢাকার নবাবগঞ্জ এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এই দিনও যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানিদের আক্রমণের দ্বিতীয় দিনও কাটে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধে। পাকিস্তানিরা কখনো পিছু হটে, কখনো শক্তি সঞ্চয় করে আবার আক্রমণে ফিরে আসে। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা শক্ত অবস্থান থেকে পাকিস্তানি হামলার মোকাবিলা করেন।

৩ সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর শাহবাজপুর অবস্থানে আক্রমণ চালান। তারাও পাল্টা আক্রমণ চালালে দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে কয়েকজন সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।

৫ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা সিলেটের জাফলংয়ে এক দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজনকে হতাহত করেন।

৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী জেলার বাগমারা থানায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ দেশীয় সহযোগী রাজাকারদের দুটি ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। এতে রাজাকারদের ক্যাম্প দুটি ধ্বংস এবং কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, দশম খণ্ড; দ্য টাইমস, যুক্তরাজ্য, ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১; ইত্তেফাক, ঢাকা, ১ অক্টোবর ১৯৭১; যুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ১ অক্টোবর ১৯৭১ ও আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত ২ ও ৩ অক্টোবর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান