বিজ্ঞাপন
default-image

যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশনের কার্যালয় উদ্বোধনের পর আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক কার্যক্রম শুরু করে। ভারতের বাইরে এই প্রথম বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের উদ্বোধন হলো। যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনের বেজ ওয়াটার এলাকার নটিংহিল গেটের কাছে ২৪ পেমব্রিজ গার্ডেনসে প্রায় ৩০০ বাঙালি এবং অনেক বিদেশি সাংবাদিকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ মিশনের উদ্বোধন করেন। মিশন উদ্বোধনের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্য বাংলাদেশের সাফল্য কামনা করে বক্তৃতা দেন।

মিশনের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করার পর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, লন্ডন থেকেই বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করা হবে। লন্ডনই হবে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনের জন্য বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্রিটেনপ্রবাসী বাঙালিরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। এই স্বাধীন দেশের সরকারি প্রতীক হিসেবে একটি মিশন স্থাপনের জন্য তাদের আগ্রহ ও বাসনা বিচার করে ১ আগস্ট ট্রাফালগার স্কয়ারের গণসমাবেশে বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের কথা ঘোষণা দেওয়া হয়। এখন থেকে ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেনসে মিশনের কাজ যথারীতি আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচালিত হবে।

বাংলাদেশ মিশনের পতাকা উত্তোলনের পর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী হল ঘরে উদ্বোধনী ভাষণ দেওয়ার সময় বিনা আমন্ত্রণে কয়েক কোচবোঝাই পুলিশ মিশনের সামনে এসে নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়। অনুষ্ঠানের শেষে তাদের সবাইকে প্রীতি অনুষ্ঠানে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হয়।

২৮ আগস্ট প্রকাশিত সংবাদপত্রে পুলিশের আকস্মিকভাবে নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণের কারণ জানা যায়। বাংলাদেশ মিশনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান চলাকালে ব্রিটেনে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সালমান আলী পররাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। প্রতিমন্ত্রী জোসেফ গডবারের সঙ্গে দেখা করে সালমান আলী বলেন, ব্রিটেন পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্র, যার একটি অংশের নাম পূর্ব পাকিস্তান। সেটির নাম বদলে বাংলাদেশ নাম নিয়ে লন্ডনে মিশন স্থাপন পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের প্রতি অবমাননাকর। তাই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া ব্রিটিশ সরকারের কর্তব্য। জোসেফ গডবার মনোযোগ দিয়ে তাঁর বক্তব্য শুনে বলেন, এ ধরনের নাম ব্যবহারে ব্রিটেন সমর্থন করে না। যুক্তরাজ্য সরকারের পাকিস্তান সরকারকে দেওয়া স্বীকৃতি অব্যাহত রয়েছে। কাজেই বাংলাদেশ মিশনকে কূটনৈতিক মর্যাদা দেওয়ার প্রশ্ন অবান্তর। প্রায় ঘণ্টাকাল আলোচনার পর সালমান আলী তাঁর কূটনৈতিক চাল সফল হয়েছে বলে অনুমান করে পররাষ্ট্র দপ্তর ত্যাগ করেন। পাকিস্তানের প্রতিবাদ সম্পর্কে পররাষ্ট্র দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র দপ্তরের মধ্যে আলোচনার মর্ম অপ্রকাশিত থাকা সত্ত্বেও বোঝা যায়, পাকিস্তানের সমর্থকদের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বাংলাদেশ মিশনের বাইরে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

পাকিস্তানের ভেতরে

পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খানের বিশেষ সহকারী ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক এ দিন পাকিস্তান সফর শেষে ঢাকার উদ্দেশে করাচি রওনা হওয়ার আগে ইসলামাবাদে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দেশে বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী। তিনি আরও বলেন, গত ২২ আগস্ট পর্যন্ত ভারত থেকে সরকারিভাবে ১ লাখ ৫৫ হাজার শরণার্থী ফিরে এসেছে। এই হিসাবের বাইরেও আরও কিছু শরণার্থী ফিরে এসেছে।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো সন্ধ্যায় রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস জি এম এম পীরজাদার সঙ্গে বৈঠক করেন। এর আগে সকালে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের সঙ্গে পিপিপির শাসনতান্ত্রিক বিশেষজ্ঞদের আলোচনা হয়। তাঁদের সঙ্গে পিপিপির শাসনতান্ত্রিক বিশেষজ্ঞদের এটা ছিল তৃতীয় ও শেষ বৈঠক।

রাওয়ালপিন্ডি থেকে এপি পরিবেশিত খবরে এ দিন বলা হয়, পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একজন বিমান পাইলট করাচির কাছে গৌরীপুর বিমান ঘাঁটি থেকে একটি বিমান নিয়ে সরে পড়ার চেষ্টা করায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সব বাঙালি পাইলটকে নজরবন্দী করা হয়েছে বলে সামরিক মহল সূত্রে জানা গেছে। খবরে বলা হয়, কয়েক দিন আগে ওই বাঙালি পাইলট বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা এ দিন ভোরে খুলনার খালিশপুরে পিপলস জুট মিলের খেয়াঘাট পেরিয়ে সেনহাটি গ্রাম হয়ে দেয়াড়া গ্রামে যায়। ভোর রাতেই বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও অবাঙালি গোটা দেয়াড়া গ্রাম ঘিরে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকে। তাঁদের না পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবদারের বাড়ি থেকে তাঁর বাবা ডা. মতিয়ার রহমানসহ ছয়জনকে ধরে রাস্তায় এনে পিঠমোড়া করে বেঁধে সেখানেই তাঁদের কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। এরপর তারা ওই গ্রামের আরও অনেককে আটকের পর ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। মোট ৬১ জনের মধ্যে ৬০ জন ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। এঁদের মধ্যে ৩৮ জনের লাশ তারা ভৈরব নদীতে ছুড়ে ফেলে এবং বাকি ২২ জনকে তিনটি গণকবরে মাটিচাপা দেয়।

বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনী

বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র মিজানুর রহমান চৌধুরী এ দিন মুজিবনগরে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েন না করার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের প্রতি আহ্বান জানান।

কুমিল্লার শশীদলে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। পরপর দুই দিন আক্রান্ত হওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী নয়ানপুরের পশ্চিম পাশে শশীদল গ্রামের কাছে জমায়েত হয়ে সেনেরবাজারে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর মর্টার আক্রমণ চালায়। দীর্ঘ যুদ্ধের পর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে। এই সংঘর্ষে দুই পক্ষে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।

মুক্তিবাহিনীর একটি দল ফেনী জেলার পরশুরামের কাছে অ্যামবুশ করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল ফেনী-বিলোনিয়া সড়কে হাসানপুর সেতু ধ্বংস করে।


সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক ও দুই; প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, আবু সাঈদ চৌধুরী, ইউপিএল; মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ; ডেইলি টেলিগ্রাফ, ২৮ আগস্ট ১৯৭১; দৈনিক পাকিস্তান, ২৮ আগস্ট ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ২৮ ও ২৯ আগস্ট ১৯৭১।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান