বিজ্ঞাপন
default-image

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বাংলাদেশের ঘটনাবলি এবং শরণার্থী সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য ২১ জুন লন্ডনে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোমের সঙ্গে দেখা করেন। ডাউনিং স্ট্রিটে এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে দেখা করে তিনি তাঁকে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং এ ব্যাপারে ভারতের মনোভাব সবিস্তার জানান। তিনি তাঁকে বাংলাদেশ থেকে
শরণার্থী আগমন বন্ধ করা এবং তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে ব্রিটেন ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। আলোচনা শেষে যুক্তরাজ্য ও ভারত একটি যুক্ত বিবৃতি দেয়।

ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্মানে একটি ভোজসভার আয়োজন করেন। সরদার শরণ সিং সে ভোজসভায় ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত করেন। পরে স্যার অ্যালেক ডগলাস হোমের সঙ্গে বৈঠক করেন। সরদার শরণ সিং তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের বর্তমান সংকটের একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানসূত্র খুঁজে বের করার ব্যাপারে আলোচনা করেন। করণীয় নিয়ে তাঁদের মধ্যে মতৈক্যও হয়।

এ আলোচনার পরে সরদার শরণ সিং লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ১৫ দিন ধরে তিনি যেসব দেশ সফর করেছেন, তাদের সরকারেরা পাকিস্তানকে অর্থ সাহায্য দেওয়া স্থগিত রাখার কথা ভাবছে। তবে ঘরোয়াভাবে শোনা সেসব বক্তব্য তিনি প্রকাশ করবেন না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পাকিস্তান নিজের দোষে নিজের অর্থ বিপর্যয় ডেকে এনেছে। তাই অর্থনৈতিক বিবেচনায় পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া নিরর্থক এবং এর মানে সংখ্যাগরিষ্ঠকে উপেক্ষা করে লঘিষ্ঠ অংশকে মদদ দেওয়া।

ব্রিটেন ও ভারত এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অনুরোধ জানায়। শরণার্থীদের দ্রুত স্বদেশে ফেরার মতো অবস্থা সৃষ্টি এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেওয়ার জন্যও দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবেদন জানান।

পশ্চিমা শিল্পোন্নত দেশগুলো এবং জাপানের প্রতিনিধিরা ২১ জুন স্থির করেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধের রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা দেখা না দেওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে নতুন করে সাহায্য দেওয়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা স্থগিত থাকবে। ১২টি দেশের সদস্য নিয়ে গঠিত পাকিস্তানকে সাহায্যকারী কনসোর্টিয়াম এর আগে স্থির করেছিল যে ভবিষ্যৎ সাহায্য সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য এদিন একটি তারিখ স্থির করা হবে।

পাকিস্তানকে সাহায্যদাতা দেশগুলোর প্রতিনিধিরা কয়েক দিন আগে পাকিস্তান সফর করে যাওয়া বিশ্বব্যাংকের এশিয়া বিভাগের পরিচালক পিটার কারগিলের কাছ থেকে পাকিস্তানের পরিস্থিতির বিবরণ শুনেছিলেন।

বাংলাদেশ সরকার

বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এক ভাষণে বলেন, ছয় দফাই বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির একমাত্র সনদ।

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং বহির্বিশ্বে বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনমত গঠনের অংশ হিসেবে ২১ জুন নেদারল্যান্ডস সফরে যান। তিনি লন্ডন থেকে বিমানযোগে দেশটির বিমানবন্দরে পৌঁছালে সাংবাদিকেরা তাঁর সাক্ষাৎকার নেন। রাতে দুজন সাংসদ হোটেলে এসে তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।

শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য

ভারতের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী সুরেশ পাল সিং সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য সরকার বন্ধু ও বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে। শেখ মুজিব এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য সরকার ওই দেশগুলোকে অনুরোধ করেছে।

ভারতের কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী আর কে খাদিলকর সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বলেন, ভারত ও পাকিস্তানে সাম্প্রতিক সফরকালে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানের করা উক্তি থেকে ধারণা হয়েছে যে তিনি পক্ষপাতমুক্ত নন। এ ধারণা ও আশঙ্কা জানিয়ে ভারত সরকার এরই মধ্যে জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেনের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। তাঁর বক্তব্যের আগে রাজ্যসভার বিভিন্ন দলের সদস্যরা প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানকে পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থীশিবিরগুলো পরিদর্শন করতে দেওয়ায় সরকারকে ভর্ৎসনা করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সের শরণার্থীবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফ্রাংক এল কেলাগ বাংলাদেশের শরণার্থীদের সম্পর্কে ভারত সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ২১ জুন দিল্লি আসেন। কেলাগ দিল্লি বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, এই শরণার্থী সমস্যা বিশ্বের অন্যতম মর্মন্তুদ ঘটনা। কেলাগ কয়েকটি শিবির পরিদর্শন করবেন।

ভারত এই দিন পাকিস্তানের কাছে দাবি করে, শরণার্থীদের ফেলে আসা সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা শরণার্থীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ নিলামে বিক্রি করছে অথবা তাদের অনুগত সহযোগীদের কাছে বন্দোবস্ত দিচ্ছে—ভারত সরকার এ বিষয়টি জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের নজরে আনে।

পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল কুমিল্লার বিজয়পুর সেতুর ওপর পাকিস্তানি সেনাদের দুটি গাড়িকে অ্যামবুশ করে। অ্যামবুশে গাড়ি দুটি ক্ষতিগ্রস্ত এবং কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা ফেনী-নোয়াখালী সড়কে বোগাদিয়া নামের স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি ট্রাককে অ্যামবুশ করলে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া নোয়াখালী-ফেনী সড়কে মুক্তিযোদ্ধারা বজরা নামক স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি টহল দলকে অ্যামবুশ করে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বড় একটি দল আখাউড়া-সিলেট রেলপথে তেলিয়াপাড়ার কাছে মুক্তিবাহিনীর মনতলা অবস্থানে আক্রমণ চালায়। এতে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অবস্থান ত্যাগ করে পিছু হটে যান।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২ ও ৩; মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ; ইত্তেফাক আজাদ, ২২ ও ২৩ জুন ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা যুগান্তর, ভারত, ২২ ও ২৩ জুন ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।