বিজ্ঞাপন
default-image

লন্ডনের একটি কূটনৈতিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বার্তা সংস্থা এপি ২৩ অক্টোবর জানায়, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আলোচনা শুরু করতে গোপনে ইয়াহিয়া খান এবং বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে এবং চাপ দিচ্ছে। এর পেছনে উদ্দেশ্য দুটি। প্রথমত, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বেধে যাওয়ার যে প্রবল আশঙ্কা তারা করছে, সেটি এড়ানো। দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের আসন্ন চীন সফর বিঘ্নিত হওয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব ঠেকানো।

কূটনৈতিক সূত্রটি জানায়, বাংলাদেশের কিছু নেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র বেসরকারিভাবে যোগাযোগ করেছে। যোগাযোগ করার উদ্দেশ্য পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে তাদের কথাবার্তা বলানোর চেষ্টা করা।

কূটনৈতিক সূত্র জানায়, সর্বোত্তম সমাধান হিসেবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বিচারাধীন শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বোঝাপড়ার অনুরোধ করা হয়েছিল। শেখ মুজিব পাকিস্তানের কাঠামোর মধে৵ স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব মেনে নেবেন, এই শর্তে ইয়াহিয়া বোঝাপড়ায় প্রস্তুত ছিলেন। তবে শেখ মুজিব নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছেন। ইয়াহিয়া তাই শেষ পর্যন্ত সাড়া দেননি।

মুক্তিযুদ্ধের প্রতি লেখকদের সমর্থন

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজে৵র রাজধানী কলকাতায় এদিন এক সমাবেশে লেখকেরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানান। বসুমতী পত্রিকা অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে। পত্রিকাটির দীপাবলি সংখ্যায় যেসব কবি-সাহিত্যিকের লেখা প্রকাশিত হয়, তাঁরা তাঁদের লেখক সম্মানী মুক্তিযুদ্ধের জন্য দান করেন। ওই সমাবেশের সভাপতি অন্নদাশঙ্কর রায় কলকাতার বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রধান এম হোসেন আলীর কাছে সম্মানীর টাকা (চেক) তুলে দেন। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন মনোজ বসু। বাংলাদেশের সাহিত্যিক শওকত ওসমান অনুষ্ঠানে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বক্তব্য দেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বেতার ভাষণে বলেন, দেশ এখন বিপদের মুখে। প্রতিরক্ষা বাহিনী ও জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে। এই বিপদের সময় দরকার ঐক্য ও শৃঙ্খলা। তিনি দেশের সব রাজনৈতিক দলকে সরকারের পাশে থাকার আহ্বান জানান।

ভারত সফররত সোভিয়েত ইউনিয়নের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করেন। আলোচনার বিষয়বস্তু প্রকাশ করা না হলেও দিল্লির ওয়াকিবহাল মহল জানায়, ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধের হুমকি এবং বাংলাদেশের সংকট নিয়ে তাঁরা আলোচনা করেন। ফিরুবিন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের সঙ্গেও বৈঠক করেন।

পাকিস্তানে, অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডি থেকে লাহোর রওনা হওয়ার আগে এ দিন সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্রের আওতায় সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, এমন যেকোনো রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর পার্টি নির্বাচনী জোট গঠনের জন্য আলোচনায় রাজি।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতা এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি মাহমুদ আলী ঢাকায় বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের উপনির্বাচনে পিপিপির পক্ষে বিস্ময়কর কিছু করা কল্পনাবিলাস মাত্র। পূর্ব পাকিস্তানে পিপিপির কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি নেই।

জাতীয় পরিষদের উপনির্বাচনে আরও তিনজন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮। ৭৮টি আসনে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের পর মোট প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০১। এর মধ্যে ১৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ৬০টি আসনে প্রার্থী এখন ১৮৩ জন।

প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে তথ্যমন্ত্রী মুজিবুর রহমানসহ আরও ১০ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল এই দিন কামান ও মর্টার নিয়ে কসবা ও নয়নপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ চালায়। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।

এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের মাইলখানেক উত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর কালীর বাজার ঘাঁটিতে হামলা করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।

৬ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা এ দিন ভোরে নীলফামারীর খড়িবাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণের জন্য সমবেত হন। পাকিস্তানি বাহিনী তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়ে আকস্মিকভাবে আক্রমণ করলে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন।

৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা রামনগর নামক স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করলে দুই পক্ষে তীব্র যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর দুজন নিহত ও তিনজন আহত হয়।

এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা মাগুরার মহম্মদপুরে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারকে হতাহত করেন।

১১ নম্বর সেক্টরের কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা কালিহাতীর চারান নামক স্থানে মিলিশিয়া ও রাজাকার সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বড় দলের ওপর হামলা করলে শত্রুপক্ষের বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, দশম ও একাদশ খণ্ড; ইত্তেফাক, ঢাকা, ২৪ অক্টোবর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ২৪ ও ২৫ অক্টোবর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান