বিজ্ঞাপন
default-image

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শরণার্থীবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতে বাংলাদেশি শরণার্থীদের শিবিরগুলো এক সপ্তাহ পরিদর্শন করে ফিরে যাওয়ার পর ২৬ আগস্ট দেশটির প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে দেখা করে তাঁর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা জানান। সিনেটর কেনেডি বলেন, ‘আমি স্বচক্ষে দেখে এসেছি, পূর্ব বাংলায় কী নিষ্ঠুর নির্যাতন চলছে। কী ভয়ংকরভাবে সেখানে নির্বিচার গণহত্যা চলছে। আপনি অবিলম্বে পাকিস্তানে সব রকম সাহায্য দেওয়া বন্ধ করুন।’

এরপর কেনেডি সাংবাদিকদের কাছে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সাহায্য অব্যাহত রাখার তীব্র সমালোচনা করে বলেন, এ ঘটনা লজ্জাজনক ও দুঃখবহ। সেটা তো হচ্ছেই না, উপরন্তু পাকিস্তানের উদ্দেশে জাহাজে অস্ত্র বোঝাইয়ের কাজ ক্রমাগত চলছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, উত্তেজনা প্রশমন ও শরণার্থীদের সাহায্যার্থে এখনই উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেওয়া গেলে পূর্ব বাংলার ঘটনাবলি পাকিস্তান ও পূর্ব ভারতে এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হতে পারে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলায় যে নির্বিচার গণহত্যা চালাচ্ছে, তার বহু প্রমাণ তিনি পেয়েছেন। বাঙালিদের প্রতি জেনারেল ইয়াহিয়া খান যাতে নরম নীতি গ্রহণ করেন, তার জন্য প্রেসিডেন্টের উচিত জেনারেল ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করা।

বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসে এই দিন একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিশিষ্ট লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এবং সালভাদর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফাদার কুইয়েসের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগম হয়। সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতাও আবৃত্তি করা হয়। আয়োজকেরা জানান, সংগৃহীত অর্থ আর্জেন্টিনার রেডক্রসের হাতে দেওয়া হবে। তারা তা ভারতীয় রেডক্রসের কাছে পাঠাবে।

দিল্লিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি কে এম শেহাবউদ্দিন ১৬ আগস্ট মিউনিখের একটি সংবাদপত্রে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রকাশিত অভিযোগের প্রতিবাদ করে দিল্লিতে এই দিন সাংবাদিকদের বলেন, ইয়াহিয়া খানের দখলদার সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণ নিজেরাই যুদ্ধ করছে। তারা কারও সাহায্য নিচ্ছে না। ভারত বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে নৈতিক ও মানবিক সমর্থন জানাচ্ছে।

ইয়াহিয়ার তৎপরতা

অবরুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক এদিন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলোচনা করেন। তিন দিন আগে ঢাকা থেকে রাওয়ালপিন্ডিতে আসার পর এ নিয়ে তাঁরা দুই দফা বৈঠক করেন। পর্যবেক্ষকেরা জানান, পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সামরিক গভর্নর টিক্কা খানের পরিবর্তে নতুন গভর্নর হিসেবে মালিককে নিয়োগ দেওয়া হবে। গভর্নর হিসেবে মালিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসনে তাঁর কী ভূমিকা থাকবে, সেসব বিষয়ে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়।

পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের যেসব নির্বাচিত সদস্যের সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে, সেসব আসনে উপনির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়।

রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টা ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির চার সদস্যবিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ দলের মধ্যে চার ঘণ্টা ধরে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। পিপিপির মুখপাত্র আবদুল হাফিজ পীরজাদা সাংবাদিকদের জানান, আলোচনা শাসনতান্ত্রিক বিষয়ের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত ছিল।

পশ্চিম পাকিস্তানে সফররত পূর্ব পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আজম এই দিন পেশোয়ারে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের হীন উদ্দেশ্য ও বিদ্রোহীদের বিশ্বাসঘাতকতা থেকে সশস্ত্র বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করেছে।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

ফেনীর ছাগলনাইয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এই দিন আমজাদহাটে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি প্রতিরক্ষা অবস্থানে মর্টার দিয়ে আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা মুহুরী নদী পার হয়ে খাদ্যসামগ্রী ও কিছু অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পিছু হটতে বাধ্য হয়।

মুক্তিবাহিনীর ৭ নম্বর সেক্টরের দুটি দল চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কিছু সময় পর পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ করে। এই আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা পেছনে সরে নিরাপদ অবস্থানে চলে যান।

রাজশাহী জেলার দুর্গাপুরে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। দলটির ওপর পাকিস্তানি সেনারা অতর্কিত আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা মর্টার ও হালকা মেশিনগানের সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান।

ময়মনসিংহ জেলার ভালুকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য একটি দল মল্লিকবাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের একটি ক্যাম্পে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

টাঙ্গাইল শহরের তিন মাইল দূরে জলপাই গ্রামে মুক্তিবাহিনীর কাদেরিয়া বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং একজনকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে যায়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, সাত ও এগারো; ইত্তেফাকআজাদ, ২৭ আগস্ট ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ২৭ ও ২৮ আগস্ট ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান