বিজ্ঞাপন
default-image

ভারতের নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল এস এম নন্দ ১২ জুন বেঙ্গালুরুতে বৈমানিক ও নাবিকদের শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজে বলেন, বাংলাদেশের ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের দিক থেকে যেকোনো চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নৌ ও বিমানসেনাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি বলেন, দেশ এখন খুব সংকটজনক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শান্তি ও অগ্রগতির পথে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার জন্য
দেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘ভারত যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত।’ যেকোনো সময় এই চ্যালেঞ্জ চলে আসতে পারে। তার মোকাবিলা করা সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আসামের কাছাড় জেলা সফর শেষে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে যা ঘটছে, সেটাকে কোনোমতেই পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার বলা যাবে না। বাংলাদেশের ঘটনাবলির ব্যাপারে পৃথিবী ক্রমেই সজাগ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হয়তো হবে না। তারপরও কিছু বলা যায় না, কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।

উপমহাদেশের বাইরে

লন্ডনের উত্তরে সেন্ট অ্যালবান্স শহরে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে এদিন সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বক্তব্য দেন। পরে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বর্তমান গণহত্যার পর দেশের দুই অংশের একসঙ্গে থাকার আর কোনো প্রশ্নই ওঠে না। পূর্ব বাংলার জনগণের সামনে এখন একমাত্র সমাধান, শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মুক্তিদান এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে দেওয়া। তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্ম হবে ব্যক্তিগত বিষয় এবং সরকার হবে ধর্মনিরপেক্ষ।

বাংলাদেশের ঘটনাবলি এবং শরণার্থী সমস্যা বিশ্বনেতাদের জানাতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এদিন ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরিস সুম্যানের সঙ্গে দেখা করেন। প্রায় ৫০ মিনিটের স্থায়ী বৈঠকে তাঁরা বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য বিশ্ব ভ্রমণরত ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ জাতিসংঘ ভবনের সামনে এদিন এক জনসমাবেশে বলেন, এখনো সময় আছে, বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানে বিশ্বের নেতারা এগিয়ে না এলে উপমহাদেশজুড়ে সৃষ্ট অশান্তি সারা বিশ্বকে অস্থির করে তুলবে। ‘বাংলাদেশ বাঁচাও’ কমিটির উদ্যোগে হাজারখানেক নর–নারী নিউইয়র্ক শহর থেকে মিছিল করে এসে এ সমাবেশে যোগ দেন। আসার সময় পাকিস্তানি মিশনের সামনে তাঁরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র এই দিন সাংবাদিকদের বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার পরিস্থিতি বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। উত্তেজনা দুই দিক থেকেই বেড়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমঝোতার ওপর জোর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ সিসকো বলেন, শরণার্থী আসা বন্ধ করতে এবং তাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন।

লন্ডনের অবজারভার পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান থেকে এক কোটি হিন্দুকে বিতাড়িত করা হচ্ছে। এর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। পাকিস্তান যদি তার মতলব না ছাড়ে, তবে নয়াদিল্লির অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হতে পারে।

দ্য টাইমস–এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলায় নির্বিচার গণহত্যা করছে। পূর্ব বাংলা থেকে একজন ব্রিটিশ নাগরিকের পাঠানো একটি চিঠিতে হত্যাকাণ্ডের চাক্ষুষ বিবরণ রয়েছে। চিঠিতে তিনি বলেন, পুরুষদের নির্মমভাবে হত্যা করে নারী ও শিশুদের ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে।

পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

পাকিস্তান সফররত ব্রিটেনের সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য ও কনজারভেটিভ দলের এমপি জে কিসপেডার এদিন ইসলামাবাদে বলেন, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন সুগম করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে অবশ্যই স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা একান্তভাবে আবশ্যক। ব্রিটিশ জনগণ ও সরকার পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিতে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি ব্রিটেনের জনগণ খুবই সহানুভূতিসম্পন্ন।

টাঙ্গাইলের কালিহাতীর বল্লায় মুক্তিবাহিনীর কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ হয়। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে।

সিলেটের এনায়েতপুরে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেশ ক্ষতি হয়। এ ছাড়া নওগাঁয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘর্ষ হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২, ৪, ৭ ও ১১; মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ; ইত্তেফাকআজাদ, ১৩ জুন ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা যুগান্তর, ভারত, ১৩ ও ১৪ জুন ১৯৭১।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান