বিজ্ঞাপন
default-image

মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর পরিকল্পনায় আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের ঢাকার রায়েরবাজার, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন আলবদর বাহিনীর আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীন।

২৫ মার্চ রাত থেকেই শুরু হয় বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের সূচনা। তবে মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এ হত্যাযজ্ঞ ভয়াবহ রূপ নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী এবং সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সার প্রমুখকে তাঁদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়।

বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন নির্যাতনকেন্দ্রে নিয়ে দৈহিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। এ ধরনের নির্যাতনকেন্দ্র ছিল মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারসহ কয়েকটি এলাকায়। বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবীকে ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করা হয়।

শহীদ হলেন বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর

চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুক্ত করার যুদ্ধে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। ১৩ ডিসেম্বর রাতে তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে মহানন্দা নদী পেরিয়ে অবস্থান নেন রেহাইচরে।

মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরদের অবস্থানের অদূরেই ছিল পাকিস্তানিদের শক্ত প্রতিরক্ষা। তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে সেখানে আক্রমণ চালান। কোনো ফল না হওয়ায় তিনি মরিয়া হয়ে ক্রল করে একটি বাংকারের দিকে এগিয়ে যান। বাংকারে ছিল পাকিস্তানিদের এলএমজি পোস্ট। গ্রেনেড ছুড়ে বাংকারটি ধ্বংস করতে তিনি সেটির কাছে পৌঁছান। কিন্তু আরেক বাংকারে থাকা পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে দেখে গুলি ছোড়ে। গুলিটি কপালে লাগলে তিনি ঘটনাস্থলেই শহীদ হন।

বীর মুক্তিযোদ্ধারা পরে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মরদেহ উদ্ধার করে সোনামসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করেন।

মালিকসহ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ

ঢাকার প্রতিরক্ষাবেষ্টনী যৌথ বাহিনীর চাপে ভাঙতে শুরু করলে পাকিস্তানি অনুগত গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিকসহ মন্ত্রিসভার সদস্যরা একযোগে পদত্যাগ করেন।

এর আগে সকালে গভর্নর হাউসে (বর্তমানে বঙ্গভবন) মালিক মন্ত্রিসভা ও প্রাদেশিক সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠক শুরু হয়। খবর পেয়ে ভারতীয় তিনটি জঙ্গি বিমান সেখানে হামলা চালায়। মালিক দৌড়ে এয়ার রেইড শেল্টারে আশ্রয় নিয়ে সেখানেই পদত্যাগপত্র লেখেন। এরপর তাঁর পদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে রেডক্রস-ঘোষিত নিরপেক্ষ এলাকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেন।

নুরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকারের সাতজন নেতা চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, তারা সাহায্য করতে সামান্য বিলম্ব করলেও পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।

বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর'র আগে পাঠানো বার্তার জবাবে দুপুরের পরে আসা এক বার্তায় ইয়াহিয়া খান যুদ্ধবিরতির অনুমোদন দেন। নিয়াজি সন্ধ্যায় ঢাকায় নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেলের কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়ে চিঠি লেখেন।

যুক্তরাজ্য-ফ্রান্সের নতুন সূত্র

মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ অবসানের লক্ষ্যে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স নিরাপত্তা পরিষদের জন্য এদিন নতুন প্রস্তাব তোলে। পরিষদের সভাপতি বলেন, বিকেলের আগে অধিবেশন শুরু হবে না। তারপরও ঢাকার পতন আসন্ন বুঝতে পেরে পরিষদের সদস্যরা অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চালাতে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের ছয় থেকে সাতটি জাহাজ মালাক্কা প্রণালি পেরিয়ে সিঙ্গাপুর অতিক্রম করে যায়।

ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনাকালে সদস্যরা এ নিয়ে সরকারকে ভীত না হওয়ার পরামর্শ দেন।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদু আজোরায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে বৈঠককালে বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অনুসৃত নীতি ঠিক নয়।

মস্কোতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের সঙ্গে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর দীর্ঘ আলোচনা করেন।

ঢাকা অভিমুখে সাঁড়াশি অভিযান

মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী বিভিন্ন দিক দিয়ে ঢাকায় অগ্রসর হয়। একটি বড় দল ফরিদপুর থেকে ঢাকার পথে মধুমতী নদী অতিক্রম করে। দ্রুত ঢাকা পৌঁছানোর জন্য দলের দুটি ব্রিগেড পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান এড়িয়ে দুই ভাগে নদী পার হয়।

যৌথ বাহিনীর একটি ব্রিগেড মানিকগঞ্জকে পাকিস্তানি সেনামুক্ত করে সাভারের দিকে এগিয়ে আসে। আরেক দল ঢাকার উত্তর দিকে তুরাগ নদের পারে পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি হয়। পশ্চিম-উত্তর সীমানা বরাবর চন্দ্রা-সাভার-মিরপুর অঞ্চল ধরে এগিয়ে আসতে থাকে যৌথ বাহিনীর আরেকটি ব্রিগেড।

ঢাকার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ডেমরায় যৌথ বাহিনী পাকিস্তানি প্রতিরোধব্যূহে আঘাত হানে। আরেকটি দল শীতলক্ষ্যা পার হয়ে রূপগঞ্জ মুক্ত করে।

মুক্তি বাহিনীর কে ফোর্সের অধিকাংশ দল মুড়াপাড়া পৌঁছে যায়। শীতলক্ষ্যা পার হয়ে তারা বালু নদের পারে অবস্থান নেয়।

হেলিকপ্টারে করে যৌথ বাহিনী গোমতী নদী পার হয়ে মেঘনাতীরবর্তী বৈদ্যেরবাজারে অবস্থান নেয়।

যৌথ বাহিনী কুমিরা অতিক্রম করে চট্টগ্রামের পাঁচ মাইলের মধ্যে পৌঁছায়। ভারতীয় রণতরি থেকে বিমান এসে চট্টগ্রামে আক্রমণ চালায়। কক্সবাজারেও হামলা চলে। পাকিস্তানি সেনাদের জলপথে পালানোর পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

উত্তরাঞ্চলের বগুড়ায় ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সদর দপ্তর ও সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি। যৌথ বাহিনী বগুড়া শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছালে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। যৌথ বাহিনীর ট্যাংক আস্তে আস্তে শহরে এগোয়। পাকিস্তানি সেনারা শহরে অবস্থান নিয়ে লড়াই চালিয়ে যায়

সূত্র: ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালী’, আবদুল মতিন, র‌্যাডিক্যাল পাবলিকেশনস, লন্ডন; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১; দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান